টমেটো দেখতে যেরকম সুন্দর ভেতরে তার তেমনই পুষ্টিতে ভরপুর। বর্তমানে খাদ্যের মধ্যে ব্যবহারের দিক থেকে টমেটো শীর্ষে। টমেটো কেটে সালাত করে অথবা তরকারি রান্না করে খাওয়া যায়। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের ফাস্ট ফুড রেস্টুরেন্ট গুলোতে খাবারের সৌন্দর্য বর্ধনে, খাবারের স্বাদ পরিবর্তনে, সস হিসেবে টমেটোর ব্যবহার বহুল। 

আমাদের দেশে টমেটোর প্রচুর পরিমাণে চাষাবাদ হয় এবং নিয়মিত আমরা টমেটো খেয়ে থাকি। কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেকেই আছে যারা টমেটোর গুণাগুণ সম্পর্কে জানেনা টমেটোর উপকারিতা সম্পর্কে জানেনা। তো আজকের কনটেন্ট শুধুমাত্র তাদের জন্য যারা জানতে চাচ্ছেন টমেটোর উপকারিতা সম্পর্কে ও খুঁটিনাটি বিষয় –

টমেটো সম্পর্কে আলোচনা 

সপুষ্পক শ্রেণীভুক্ত “সোলানাম লাইকোপারসিকাম” বৈজ্ঞানিক নামের উদ্ভিদের ভোজ্য রসালো ফল হচ্ছে টমেটো। বিশেষজ্ঞদের মতে, মধ্য আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় টমেটোর উৎপত্তি। প্রথম দিকে ইউরোপিয়ানরা টমেটোকে মনে করেছিল বিষাক্ত। তারা ভেবেছিল হয়তোবা এটা খেলে শরীরের জন্য বড় ক্ষতি হয়ে যাবে এবং তখন তারা টমেটোকে এড়িয়ে চলে। কিন্তু পরবর্তীতে স্প্যানিশরা প্রথম টমেটো খাওয়া শুরু করে এবং তারা প্রমাণ করে যে টমেটো কোন বিষাক্ত ফল বা সবজি নয়। তখন থেকে টমেটো খাওয়ার প্রচলন শুরু হয়ে যায়। 

টমেটোর পুষ্টিগুণ 

রসালো এই ফলটি পুষ্টিতে ভরপুর এবং শরীরের নানাবিদ চাহিদার যোগানদাতা। মানব দেহের পুষ্টির চাহিদা মেটানোর জন্য টমেটো বেশ উপকারী। টমেটোতে যা যা পাওয়া যায় –

  • ১৮৯ গ্রাম টমেটোতে পাবেন ১০০ শতাংশের মধ্যে 
  • ভিটামিন সি ৩৮%, 
  • পটাশিয়াম পাবেন ১৩%, 
  • ম্যাঙ্গানিজ পাবেন ১০%, 
  • ভিটামিন কে ১৮%, 
  • ভিটামিন এ ৩০% 
  • এছাড়া টমেটোতে পাওয়া যায় ভিটামিন ই, আয়রন ও আশ। 

টমেটো খাওয়ার উপকারিতা কি কি?

টমেটো খাওয়ার নানাবিধ উপকারের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু উপকার নিয়ে আজকের আলোচনা –

  • চোখের সুরক্ষা: 

চোখের সুরক্ষার জন্য টমেটো বেশ উপকারী। টমেটোর মধ্যে ৩০% ভিটামিন এ থাকে আর ভিটামিন এ চোখের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভিটামিন এ এর অভাবে রাতকানা রোগ হয়। এছাড়াতোর মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি আছে শরীরে ভিটামিন এ এর পর্যাপ্ত অভাব হলে অ্যানিমিয়া হবার আশঙ্কা থাকে। নিয়মিত টমেটো খেলে ভিটামিন এ এর চাহিদা অনেকটা পূরণ হয় এবং চোখের নানাবিধ সমস্যার সমাধান হয়। চোখের সুরক্ষায় ভিটামিন এ এর গুরুত্ব অপরিসীম। 

  • ত্বক ভালো রাখতে সাহায্য করে: 

ত্বকের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি আছে এবং ভিটামিন সি ত্বকের নানান ধরনের রোগ থেকে রক্ষা করে। টমেটোর মধ্যে ভিটামিন সি পাওয়া যায় 38%। ত্বকের মধ্যে ভিটামিন সি এর পরিমাণ কমে  যাওয়ার কারণে ত্বকের মধ্যে লালচে দাগ, ত্বকের মধ্যে ছোট ছোট ফুসকুড়ি, শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা হওয়া, শরীরে অবসাদ সৃষ্টি হয়। এছাড়া স্কার্ভি রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এসব রোগ থেকে মুক্ত থাকার জন্য নিয়মিত টমেটো খাওয়া প্রয়োজন। খাবারের তালিকায় নিয়মিত টমেটো রাখার ফলে শরীরের ভিটামিন সি এর চাহিদা অনেকটা পূরণ হবে। 

  • দাঁতের সুস্থতায় : 

দাঁতের সুস্থতায় টমেটো হতে পারে অকল্পনীয়। টমেটোর মধ্যে অধিক পরিমানে লাইকোপিন থাকার কারণে দাতের ক্ষয় হওয়া  থেকে রক্ষা করে। এছাড়া দাতকে করে তোলে শক্ত ও মজবুত। দাতের মারি ফুলে গেলে বা দাতে ব্যাথা হলে টমেটো ক্ষেতে পারেন। 

  • ক্যান্সার প্রতিরোধে : 

ক্যান্সারের একমাত্র উপায় হলো তাকে প্রতিরোধ করা। একবার ক্যান্সার হয়ে গেলে আর কোন উপায় থাকে না। লাল টমেটো খেলে প্রচুর পরিমাণে লাইকোপিন যায় যা ক্যান্সারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তাই নিয়মিত টমেটো খেতে হবে টমেটো খেলে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। 

  • শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে

টমেটোর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের উপাদান থাকার কারণে তা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। টমেটোর মধ্যে বিভিন্ন এন্টিঅক্সিডেন্ট থাকার কারণে শরীরের রোগ প্রবেশ করতে পারে না। 

  • হজম শক্তি বৃদ্ধিতে 

হজম শক্তি বৃদ্ধিতে ভিটামিন সি এর গুরুত্ব অপরিসীম আর টমেটোর মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি পাওয়া যায়। হজমের সমস্যার কারণে যারা খেতে ভয় পান তাদের সমস্যার সমাধান হতে পারে ভিটামিন সি যুক্ত এই টমেটো। 

  • লিভার সুস্থ রাখতে 

মানব শরীরের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ আছে লিভার। বর্তমানে লিভারের নানান ধরনের রোগ দেখা যায়। লিভারের রোগ হলে তা হয় দীর্ঘমেয়াদি এবং ব্যয়বহুল চিকিৎসা পদ্ধতি। তাই লিভারের সুস্থতায় টমেটো হতে পারে চমকপ্রদ। টমেটোর বিভিন্ন পুষ্টি গুনাগুন লিভারের সক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। 

  • মস্তিষ্কের সুস্থতায় 

একটা মানুষকে তখনই সুস্থ মনে হয় যখন সে মানসিকভাবে সুস্থ থাকে। আর যে ব্যক্তি মানসিকভাবে সুস্থ সে শারীরিকভাবেও সুস্থ। টমেটো মস্তিষ্কের জন্য অপরিসীম  ভূমিকা পালন করে। টমেটোর নানাবিদ  গুণাগুণের জন্য মস্তিষ্ক খুব ঠান্ডা থাকে এর ফলে মানুষের মেজাজও ঠিক থাকে। তাই আমাদের সবার নিয়মিত টমেটো খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। 

  • গর্ভাবস্থায় 

একজন গর্ভবতী মহিলার জন্য একই সাথে বিভিন্ন ভিটামিনের প্রয়োজন হয়। টমেটোতে আছে ভিটামিন এ, ভিটামিন ই, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, লৌহ, ভিটামিন সি ও পটাশিয়াম। নিয়মিত পরিমাণ মতো  টমেটো খেলে গর্ভবতীর জন্য যেমন ভিটামিনের চাহিদা পূরণ হবে তেমনি অনাগত শিশুর জন্যেও ভালো। 

টমেটো ফল নাকি সবজি? 

আসলে টমেটো ফল নাকি সবজি এটা নিয়ে অনেক মতবিরোধ আছে। উদ্ভিদবিজ্ঞানের মতে টমেটো আসলে একটি ফল। টমেটো ফল হলেও সারা বিশ্বে সবজি হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। টমেটো কাঁচা অবস্থায় খাওয়া যায়, পাকা অবস্থায়ও খাওয়া যায়, সালাত হিসেবে ব্যবহারিত হয়, সস বানিয়ে খাওয়া যায়। এছাড়া বড় বড় রেস্টুরেন্টে খাবারের উপরে সৌন্দর্য বর্ধনে টমেটো ব্যবহৃত হয়। 

টমেটো কি ওজন কমাতে সাহায্য করে? 

হ্যা, অভিজ্ঞ গবেষকগন গবেষণা করে দেখেছেন টমেটো খেলে দৈহিক ওজন কমে যায় এবং শরীরের বাড়তি মেদ ঝরে যায়। যারা ডায়েট করছেন তাদের নিত্যদিনের খাদ্য তালিকায় টমেটো রাখা বাঞ্চনীয়। 

টমেটো বেশি খেলে কি ক্ষতি হয়? 

টমেটোতে সাইট্রিক এসিড ও মেলিক এসিড থাকার কারণে আমরা যদি কোন কারণে টমেটো বেশি খেয়ে ফেলি তাহলে পাকস্থলীর জন্য বিরূপ প্রভাব ফেলবে। পাকস্থলীতে  অতিরিক্ত গ্যাস্ট্রিকের চাপ বেড়ে যাবে। টমেটো বেশি খাওয়ার কারণে এলার্জিজনিত সমস্যা বেড়ে যেতে পারে অথবা ডায়েরিয়া হতে পারে।

কাঁচা টমেটো খেলে কি হয়? 

কাঁচা টমেটো খেলে কোন সমস্যা হয় ন।  শরীরের সুস্থতায় শরীরকে বিশুদ্ধ করতে, শরীরের জন্য ক্ষতিকারক টক্সিন শরীর থেকে বের করতে চিকিৎসকরা নিয়মিত কাঁচা টমেটো খেতে বলেন। চুলের সুস্থতায,  চুলের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে কাঁচা টমেটো খাওয়া উচিত। 

টমেটোর অর্থনৈতিক গুরুত্ব 

বর্তমানে দেশের লাখ লাখ মানুষ  টমেটো চাষ করে অধিকভাবে লাভবান হচ্ছে। বাংলাদেশে উন্নত জাতের টমেটোর  জাত থাকায় কৃষকরা বর্তমানে ভালই লাভবান হচ্ছে। টমেটো সারা বছরে চাষ করার পদ্ধতি আছে এবং বাজারে এর চাহিদা প্রচুর। বর্তমানে টমেটো চাষের শীর্ষে আছে ভারত। টমেটো উচ্চ ফলনশীল এবং স্বল্পমেয়াদি ফসল হওয়ায় গাছ থেকে অতি অল্প সময়ে অধিক পরিমাণ টমেটো সংগ্রহ করে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এতে কম সময়ে মুনাফা সহ লাভবান হওয়া যায় 

টমেটো খাওয়ার অপকারিতা কি? 

প্রত্যেক খাবারের মধ্যে ভালো মন্দ কিছু বৈশিষ্ট্য থাক।  তেমনি টমেটো অতিরিক্ত খেলে দেহে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হতে পারে। 

  • যদি টমেটো অতিরক্ত খাওয়া হয় তাহলে এসিডিটির সমস্যা বেড়ে যাবে। 
  • টমেটো বেশি পরিমাণে খেলে হজমে সমস্যা হয়ে যায়। 
  • এছাড়া পেটের সমস্যা হয়ে ডায়রিয়া হতে পারে। 
  • এলার্জি বেড়ে যেতে পারে। 
  • কিডনি রোগীদের ডাক্তারের পরামর্শ দিতে হবে নয়তো কিডনের সমস্যা বেড়ে যাবে। 

খালি পেটে টমেটো খেলে কি হয়? 

খালি পেটে টমেটো খাওয়া একদমই  অনুচিত। টমেটোর মধ্যে থাকা পেকটিন ও ট্যানিক এসিডের সাথে বিক্রিয়া হয় এবং এতে করে পাকস্থলীতে ক্ষারজাতীয় পিচ্ছিল পদার্থের সৃষ্টি হয় যা পাকস্থলী পাথরের কারণ। এজন্য কখনোই খালি পেটে টমেটো খাওয়া উচিত নয়। 

মন্তব্য 

এতক্ষণ আমরা আমাদের আর্টিকেলে টমেটো খাওয়ার উপকারিতা এবং টমেটো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করলাম। আশা করি আপনারা সবাই মনোযোগ সহকারে বুঝতে পারছেন। যদি কোনো প্রশ্ন থাকে তাহলে অবশ্যই আমাদের কমেন্টে  জানাবেন। আমরা অধির আগ্রহে আপনার প্রশ্নের উত্তর দিবো।ধন্যবাদ। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *