মেথির উপকারিতা ও অপকারিতা

মেথির ইংরেজি নাম Fenugreek। আর এর বৈজ্ঞানিক নাম Trigonella feonum-graecum। মেথি একটি মৌসুমী ও বর্ষজীবী গাছ। বছরে একবার মাত্র ফুল ও ফল হয়। তিনটি করে পাতা একসাথে জন্মায়। ফুলে ও তিনটা করে পাপড়ি থাকে। স্ত্রী এবং পুরুষ দুই ধরনের ফুল হয়। বাদামি-হলুদ বর্ণের প্রায় চারকোনা আকৃতির বীজ হয়। রঙ সাধারণত সাদা ও হলুদ হয়ে থাকে।মেথি বীজ আকারে অনেক ছোট হয়। আজকে আমরা এই লেখায় মেথির উপকারিতা ও অপকারিতা এবং পুষ্টিগুণ সম্পর্কে আলোচনা করব

মেথির গুনাগুন

মেথিকে মসলা, খাবার,পথ্য হিসেবে  বলা চলে। মেথির স্বাদ তিতা হলেও এর রয়েছে অনেক গুনাগুন। এতে রয়েছে রক্তের চিনির মাত্রা কমানোর বিস্ময়কর শক্তি। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে মেথি চিবিয়ে খেলে বা এক গ্লাস পানিতে মেথি ভিজিয়ে রেখে সেই পানি পান করলে শরীরের রোগ-জীবাণু মারা যায়, বিশেষত কৃমি মারা যায়, রক্তের চিনির মাত্রা কমে। রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল বা চর্বির মাত্রা কমে যায়।

গরমে ত্বকে যে ঘা, ফোড়া, গরমজনিত ত্বকের অসুখ হয়, এই অসুখগুলো দূর করে মেথি। বার্ধক্যকে দূরে ঠেলে দিয়ে তারুণ্যকে দীর্ঘস্থায়ী করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে মেথি। গবেষণা করে দেখা গেছে, যে ডায়াবেটিক রোগীরা নিয়মিত মেথি খান, তাদের ডায়াবেটিসজনিত অসুখগুলো কম হয় এবং স্ট্রোক হওয়ার প্রবণতা তুলনামূলকভাবে কম। ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য মেথি শ্রেষ্ঠ পথ্য হিসেবে ধারণা করা হয়। এছাড়া এতে আছে- ফাইবার,প্রোটিন,কার্বোহাইড্রেট,আয়রন, ফ্যাট, মাংগানিজ, ম্যাগনেশিয়াম,কোলিন, ইনোসিটল, বায়োটিন,ভিটামিন-বি,জিংক, পটাশিয়াম, সেলেনিয়াম।

মেথির উপকারিতা

মেথির খাওয়ার উপকারিতা

যেকোন কাচা বাজার / মসলার বাজারে আপনারা মেথি পেয়ে যাবেন অনায়েসে। আপনি আপনার চাহিদা অনুযায়ী কিনে নিতে পারবেন। মেথির উপকারিতা সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো –

১. ওজন কমাতেঃ কেউ যদি ওজন কমানোর চিন্তা করেন তাহলে মেথির ব্যবহার এর জন্য সহায়ক হতে পারে। মেথি শরীরে মেদ জমতে বাধা দেয়। এতে ভালো পরিমাণে ফাইবার পাওয়া যায়, যা খাদ্য হজমের পাশাপাশি ক্ষুধা নিবারণে কাজ করে। এটি ওজন বৃদ্ধি প্রতিরোধ করতে পারে।  এছাড়াও  মেথিতে বিভিন্ন ধরণের পলিফেনল পাওয়া যায়, যা ওজন হ্রাস করতে পারে।

২. চুল পড়া রোধেঃ মেথি ব্যবহার করলে চুল পড়া বন্ধ হয়। একটি চিকিৎসা গবেষণা অনুসারে, মেথি বীজে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন রয়েছে, যা চুলের জন্য প্রয়োজনীয়। এটি টাক পড়া, চুল পাতলা হওয়া এবং চুল পড়া নিরাময়ে সাহায্য করে। এছাড়াও মেথিতে লেসিথিন পাওয়া যায়, যা চুলকে ময়েশ্চারাইজ করার পাশাপাশি প্রাকৃতিক মজবুতকারী হিসেবে কাজ করতে পারে। এটি খুশকি দূরে রাখতে পারে। এমন অবস্থায় চুলে মেথির গুঁড়োর উপকারিতা দেখা যায়।

৩. হজমে সহায়কঃ মেথির গুনাগুনের মধ্যে খাবার হজমেও সাহায্য করে থাকে। বিভিন্ন খাবার রান্নার কাজে মেথি ব্যবহার করলে খাবার হজম করতে সুবিধা হয়।

৪. রক্তে গ্লুকোজ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেঃ ডায়াবেটিস রোগীদের খাবার ও পানীয়ের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হয়। তাদের খাদ্যাভ্যাস অন্যান্যদের মত নয় তাই তারা তাদের খাদ্যতালিকায় মেথির বীজ অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। এটি নিশ্চিত করতে, একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা করা হয়েছিল এবং তার হিসাব অনুসারে, মেথির বীজ খেলে রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। 

এছাড়া এটি টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের ইনসুলিন প্রতিরোধ ক্ষমতা কমাতে কাজ করতে পারে। অন্যদিকে, অপর একটি গবেষণা অনুসারে, ডায়াবেটিসের উপর এর উপকারী প্রভাব এটিতে উপস্থিত হাইপোগ্লাইসেমিক প্রভাবের কারণে হতে পারে। তাছাড়া মেথি রক্তে সুগারের পরিমাণ কমাতে পরিচিত। তাই যাদের রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিক রয়েছে, তাদের এটি অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।

৫. উজ্জ্বল ত্বকের জন্যঃ একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বলা হয়েছে, যে মেথিতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টি-রিঙ্কেল, ময়েশ্চারাইজিং এবং ত্বক মসৃণ করার বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তাই সপ্তাহে ২-৩ বার মেথি ত্বকের যত্নে ব্যবহার করতে পারেন। যার মাধ্যমে আপনাকে আরও উজ্জ্বল দেখাবে।

৬. ক্যান্সার দূর করতেঃ ক্যান্সার একটি মারাত্মক ব্যাধি।এই রোগের জন্য অনেক গবেষণা করার পরেও এখন পর্যন্ত ক্যান্সারের কোন প্রতিষেধক পাওয়া যায়নি।  তবে ক্যান্সার রোগে মেথি বীজের উপকারিতা দেখা যায়। একটি চিকিৎসা গবেষণা অনুসারে, মেথিতে ক্যান্সার প্রতিরোধী প্রভাব পাওয়া যায়, যা ক্যান্সারের সমস্যাকে দূরে রাখতে কাজ করতে পারে।

৭. স্থূলতা দূর করেঃ মেথি  শরীরে মেদ জমতে বাধা দেয়।এতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে যা ক্ষুধা নিবারণের কাজ করে। ফলে শরীরে মেদ জমতে পারে না এবং আমাদের শরীরকে সবসময় সুস্থ সতেজ রাখে।

৮. কিডনি রোগের সহায়কঃ আপনার ডায়েটে মেথি অন্তর্ভুক্ত করা কিডনির কার্যকারিতা উন্নত করতে পারে। মেথির বীজে পলিফেনলিক ফ্ল্যাভোনয়েড পাওয়া যায়, যা কিডনিকে ভালোভাবে কাজ করতে সাহায্য করে।  এছাড়া এটি  কিডনির চারপাশে একটি প্রতিরক্ষামূলক ঢাল তৈরি করে, যাতে এর কোষগুলিকে ধ্বংস থেকে রক্ষা করা যায়। অনেক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এটা প্রমাণিত হয়েছে, যে মেথি কিডনির জন্য উপকারী। আমাদের কিডনি সুস্থ রাখতে মেথি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

৯. মাংশপেশীর ব্যথা দূর করতেঃ আয়রন, ক্যালসিয়াম এবং ফসফরাস  প্রচুর পরিমাণে মেথিতে পাওয়া যায়। তাই মেথির ঔষধিগুণ হাড় এবং জয়েন্টগুলিতে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে, যার কারণে হাড় সুস্থ ও মজবুত থাকে। এছাড়া মেথিতে অ্যান্টিইনফ্লেমেটরি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। এই উপকারী উপাদান জয়েন্টগুলোতে প্রদাহ কমিয়ে বিভিন্ন ধরনের ব্যথা উপশম করতে সাহায্য করতে পারে। 

১০. কোলেস্টেরল কমায়ঃ শরীরে কোলেস্টেরল বেড়ে যাওয়ার কারণে অনেক সমস্যা দেখা দেয়। এমন পরিস্থিতিতে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে মেথির ব্যবহার একটি ভালো বিকল্প হতে পারে। মেথির বীজে নারিনজেনিন নামক একটি ফ্ল্যাভোনয়েড থাকে যা রক্তে লিপিডের মাত্রা কমাতে কাজ করতে পারে। এছাড়াও, এটিতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যার কারণে রোগীর উচ্চ কোলেস্টেরল হ্রাস করা যেতে পারে। তাই কোলেস্টেরল কমাতে মেথি বীজ উপকারী হতে পারে।

১১.পুরুষের যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধিঃ  পুরুষদের মধ্যে টেস্টোস্টেরন নামক যৌন হরমোন থাকে। এই হরমোন শুক্রাণুর সংখ্যা এবং উর্বরতা বাড়ায়। টেস্টোস্টেরন হরমোন পুরুষদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে বা কিছু চিকিৎসা অবস্থার কারণে কমতে শুরু করে। মেথি বীজ এই হরমোন তৈরিতে সাহায্য করে।  মেথির বীজে Furostanolic saponin পাওয়া যায় যা টেস্টোস্টেরন হরমোন তৈরিতে সাহায্য করে এবং এটি শুক্রাণুর সংখ্যাও বাড়ায়।

১২.মাসিকের ক্ষেত্রে উপকারী মেথিঃ মাসিকের সময় মহিলাদের অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। মেথির বীজ মাসিক সংক্রান্ত নানান সমস্যা থেকে মুক্তি দিতেও সাহায্য করতে পারে। মেথি বীজে প্রদাহরোধী, বেদনানাশক, অ্যান্টিস্পাসমোডিক এবং মূত্রবর্ধক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। মেথির এই উপকারী উপাদানগুলি মাসিকের সমস্ত ধরণের ব্যথা থেকে মুক্তি দিতে কাজ করতে পারে । মনে রাখতে হবে ঋতুস্রাবের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শে অল্প পরিমাণে খেতে হবে।

আরও পড়ুন: মধু খাওয়ার নিয়ম, উপকারিতা ও অপকারিতা

মেথির ব্যবহার

  • মেথি বীজের ভেষজ চাও পান করতে পারেন । পানিতে মেথি দানা দিয়ে ফুটিয়ে নিন। স্বাদের জন্য এতে লেবু ও মধু যোগ করতে পারেন । এটি সকালে এবং সন্ধ্যায় পান করতে পারেন ।
  • এক চা চামচ মেথি দানা সারারাত পানিতে ভিজিয়ে রাখুন এবং পরদিন সকালে এক গ্লাস পানির সাথে পান করুন। সকালে খালি পেটে যে পানিতে মেথির বীজ ভিজিয়ে রাখা হয়েছিল সেটাও খেতে পারেন।

মেথি খাওয়ার অপকারিতা

আমরা তো অনেক জানলাম মেথির উপকারিতা সম্পর্কে কিন্তু এবার আমরা জানব কিভাবে মেথি খাওয়া ক্ষতিকর হতে পারে অর্থাৎ মেথির কিছু অপকারিতা সম্পর্কে –

এতে কোনো সন্দেহ নেই যে মেথির বীজ স্বাস্থ্যের জন্য অনেক প্রয়োজনীয় উপাদান । আপনার খাদ্যতালিকায় এটি অন্তর্ভুক্ত করার ফলে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য উপকারিতা থাকতে পারে, কিন্তু অনেক সুবিধার সাথে এর কিছু অসুবিধাও রয়েছে। কিছু কিছু  ক্ষেত্রে এর ব্যবহার অনেক সমস্যা দেখা দিতে পারে। এখানে আমরা মেথির ক্ষতি সম্পর্কে বিস্তারিত বলছি।

ডায়রিয়াঃ যদিও মেথির বীজ হজমশক্তির জন্য ভাল তবে কখনো কখনো  এটি ডায়রিয়ার কারণও হয়। খুব বেশি মেথি খেলে পেট খারাপ এবং ডায়রিয়া হতে পারে। স্তন্যপান করানো মহিলাদের যদি এটি খাওয়ার পরে পেট খারাপ হয় তবে এটি শিশুর ডায়রিয়াও হতে পারে। অতএব এই জাতীয় লক্ষণ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে এটি খাওয়া বন্ধ করুন।

জরায়ু সংকোচনঃ  মেথি বীজের একটি উষ্ণতা প্রভাব আছে। গর্ভবতী মহিলা যদি এটি অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ করেন তবে অকাল জরায়ু সংকোচনের মতো সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। মেথির বীজে অক্সিটোসিন থাকে যা জরায়ু সংকোচন ঘটায়। তাই গর্ভবতী মহিলাদের শুধুমাত্র ডাক্তারের পরামর্শেই মেথির বীজ খাওয়া উচিত।

 শিশুদের জন্য ক্ষতিকরঃ মেথি বীজ শিশুদের জন্য নিরাপদ বলে মনে করা হয় না। আমরা আগেই বলেছি যে এটি খেলে ডায়রিয়া হতে পারে। পাশাপাশি, এর ভেষজ চা পান করা শিশুদের জন্য ভাল হবে না, কারণ এটি তাদের মস্তিষ্কের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে। তাই শিশুদের মেথি সাপ্লিমেন্ট না দেওয়াই ভালো।

এলার্জিঃ কিছু লোকের মেথির বীজ খেলে এলার্জি  হতে পারে। এলার্জির কারণে  মুখের উপর ফোলা দেখা যায়। সেই সঙ্গে কারো কারো শরীরে ফুসকুড়ি হতে পারে। এছাড়া শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যাও হতে পারে এবং কেউ কেউ অজ্ঞান হতে পারে। তাছাড়া মেথি খাওয়ার পর অনেকেই বুকে ব্যথার অভিযোগ করেন। এর প্রভাব গরম, তাই কিছু লোক পাইলস, গ্যাস এবং পেট খারাপের অভিযোগ করে। এছাড়া কেউ যদি কোন রোগের জন্য ওষুধ খায়, তবে তাকে অবশ্যই মেথির বীজ খাওয়ার আগে তার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করতে হবে।

সর্তকতা

ভেষজ উদ্ভিদ হিসাবে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক, ইরান, নেপাল ইত্যাদি দেশে ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া হাজার বছর ধরে মেথি চীনে চিকিৎসা সেবায় ব্যবহার হয়ে আসছে। যে কোনো কিছুর অতিরিক্ত গ্রহণ ক্ষতিকর। তাই সুষম উপায়ে মেথি খান। নানা পুষ্টিবিদদের মতে, একদিনে ১ থেকে ১.৫ চা চামচের বেশি মেথির বীজ খাওয়া উচিত নয়। আপনি যদি মেথি গুঁড়ো গ্রহণ করেন তবে দিনে মাত্র ১ চা চামচ খান। মেথি বেশি পরিমাণে খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা কমে যায়। এর অতিরিক্ত সেবনে ডায়রিয়া, গ্যাস বা এলার্জির সমস্যা হতে পারে।

সকালে খালি পেটের পাশাপাশি, নানা সময় মেথি খাওয়ার উপকারিতা রয়েছে। খালি পেটে মেথি খাওয়া রক্তচাপ থেকে মাসিক পর্যন্ত ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। মেথিতে এমন বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়, যার কারণে এটি ওজন কমাতেও সহায়ক। মেথি বীজ নানাভাবে ব্যবহার করা যায়। আপনি এখানে উল্লেখিত পদ্ধতি অবলম্বন করে আপনার স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে পারেন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *