ডায়াবেটিস নিয়ে আমাদের সমাজে অনেক প্রচলিত ভুল ধারণা রয়েছে।ডায়াবেটিস মুলত একটা অনিরাময় যোগ্য দীর্ঘমেয়াদি রোগ।আমাদের শরীরের অভ্যন্তরে থাকা অঙ্গ অগ্নাশয় যখন পর্যাপ্ত পরিমাণে ইনসুলিন হরমোন তৈরি করতে পারেনা তখন ই মুলত ডায়াবেটিস হয়।ডায়াবেটিস হলে রক্তে শর্করার মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। মুলত ইনসুলিন হরমোন এর কাজ হলো আমাদের খাওয়া খাবার থেকে তৈরি গ্লুকোজ কে কোষে প্রবেশ করানো যা থেকে শরীরে শক্তির যোগান নিশ্চিত হয়।কিন্তু যখন অগ্নাশয় প্রয়োজনীয় পরিমাণে ইনসুলিন তৈরি কর‍তে পারেনা বা তৈরিকৃত ইনসুলিন হরমোন ঠিকমতো তার কাজ কর‍তে পারেনা , তখন এই অতিরিক্ত গ্লুকোজ গুলো রক্তে থেকে যায় এবং পরবর্তীতে তা ডায়াবেটিস সৃষ্টি করে।

ডায়াবেটিস হলে রক্তে সুগারের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায় আর এই রোগ ধীরে ধীরে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ গুলো যেমন: হৃদপিণ্ড, যকৃত,কিডনি, স্নায়ুতন্ত্র, চোখ, দাত, রক্ত সংবহন তন্ত্র এসবের মারাত্মক ক্ষতি তথা অঙ্গ গুলোকে বিকল করে দিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে। তবে যদিও ডায়াবেটিস সম্পুর্ণ ভাবে নিরাময় হয়না, কিন্তু পরিপূর্ণ চিকিৎসা এবং নিয়মকানুন মেনে জীবন যাপন করলে এই রোগ নিয়ন্ত্রণ এ থাকে। এই রোগ নিয়ে প্রচলিত আছে নানান ভ্রান্ত ধারণা যার চিকিৎসা বিজ্ঞানে কোনো ভিত্তি নেই।চলুন দেখে নেয়া যাক কি সেই ভুল ধারণা গুলো……

অতিরিক্ত চিনি বা মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয়:

ডায়াবেটিস মুলত হয় অগ্নাশয় যখন পর্যাপ্ত পরিমাণে ইনসুলিন হরমোন নিসরণ কর‍তে পারেনা কিংবা ইনসুলিন বিটা কোষ গুলো যখন  অকার্যকর হয়ে যায়।  সরাসরি অতিরিক্ত মিষ্টি বা চিনিযুক্ত খাবার খাওয়ার কারণে ডায়াবেটিস হয় এ কথার কোনো ভিত্তি নেই। তবে অতিরিক্ত মিষ্টি স্থুলতা বাড়ায় যা টাইপ -২ ডায়াবেটিস হওয়ার জন্য দায়ী।অন্যদিকে ডায়াবেটিস রোগী বেশি মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস বেড়ে যায়। তাই অতিরিক্ত মিষ্টি খাবার না খাওয়াই ভালো। 

ডায়াবেটিস শুধুমাত্র বয়সে বড়দের হয়: 

ডায়াবেটিস যে শুধুমাত্র বয়সে বড়দের হয় এটা ভাবা সম্পুর্ণ ভুল কারণ দেখা গেছে অনেক ছোট বাচ্চাদের,কিশোর বয়সী কিংবা তরুণ তরুণী দেরও ডায়াবেটিস হয়। ডায়াবেটিস দুই প্রকার ১. টাইপ-১, ২. টাইপ-২ ডায়াবেটিস। টাইপ -১ ডায়াবেটিস হয় ৩০ বছরের নিচে বয়সী মানুষ দের।অপরদিকে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হয় ৪০ বছরের উপরে বয়সী মানুষদের।সুতরাং ডায়াবেটিস শুধুমাত্র বড়দের রোগ নয়,ছোটদেরও এই রোগ হতে পারে।

ডায়াবেটিস রোগীরা রক্তদান করতে পারেনা:

 অনেকেই ভাবেন যে ডায়াবেটিস রোগীরা রক্তদান করতে পারবেন না, বা তাদের রক্ত নিলে গ্রহীতার ও ডায়াবেটিস হবে। এই ধারণা সম্পুর্ণ সঠিক নয়। শুধুমাত্র সেই সব ডায়াবেটিস রোগীরা রক্তদান করতে পারবেন না, যারা নিয়মিত ইনসুলিন গ্রহন করেন।এছাড়া বাকি যেসব রোগী শুধুমাত্র ঔষধ খান তারা রক্ত দিতে পারেন।

যেসব গর্ভবতী মায়েদের ডায়াবেটিস থাকে তাদের সন্তানদের ও ডায়াবেটিস হয়:

ডায়াবেটিস আক্রান্ত গর্ভবতী মানেই তার সন্তান ও এই রোগ নিয়েই জন্মাবে এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। গর্ভাবস্থায় সঠিক চিকিৎসা নেওয়ার মাধ্যমে সন্তানের এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। 

ডায়েবেটিস রোগীরা মিষ্টি ফল খেতে পারবেনা: 

অনেকেই ভাবেন ডায়াবেটিস রোগীদের মিষ্টি ফল খাওয়া উচিৎ নয়। এটা একটা ভুল ধারণা। ফল অধিক পরিমাণে ভিটামিন ও ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার। এটা সবার জন্যই উপকারী। ফল ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য যথেষ্ট সাস্থ্যকর। বরংচ ফলে কেক, মিষ্টি,বিস্কুট, হালুয়া এসবের থেকে কম চিনি রয়েছে।ডায়েবেটিস রোগীরা খেতে পারে এমন ফল গুলো হলো: আম,কালোজাম,কলা,পেঁপেঁ, আপেল,তরমুজ, আঙুর, নাশপাতি, এভোকেডো,শশা, বাঙ্গি, লেবু,স্ট্রবেরি ইত্যাদি।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রিত হলে আর ঔষধ খেতে হয়না: 

ডায়াবেটিস যেহেতু সম্পুর্ণ নিরাময় যোগ্য নয় তাই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রন এ আসলে আর ঔষধ খেতে হয়না এটা ভাবা ঠিক নয় । ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রিত হবার পরেও নিয়ম মাফিক ব্যায়াম,সাস্থকর ডায়েটের পাশাপাশি নিয়মিত ডায়াবেটিস এর ঔষধ খেতে হবে।

পরিবারের সব সদস্য ডায়াবেটিস মুক্ত থাকলে নিজের ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুকি নেই: 

যাদের পরিবারে সদস্যদের পুর্বে থেকে ডায়াবেটিস আছে তাদের পরিবারের বাকি সদস্য দের টাইপ -২ ডায়াবেটিস এর ঝুকি বেড়ে যায়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে পরিবারের কোনো সদস্যের পুর্বে থেকে ডায়াবেটিস না থাকলে অন্যদের ডায়াবেটিস হবেনা। যারা বেশ স্থুলকায়, প্রিডায়াবেটিস আছে, পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম আছে, বয়স ৪০ এর উপরে, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ছিলো এমন মানুষ দের পুর্ব পারিবারিক ডায়াবেটিস হিস্ট্রি না থাকলেও তারা টাইপ -২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুকিতে থাকে।

প্রিডায়াবেটিক দের ডায়াবেটিস হয়না: 

প্রিডায়াবেটিক মানুষদের ডায়াবেটিস হবে না এমন টা ভাবা সম্পুর্ণ ভুল। বরং প্রিডায়াবেটিক দের আগামী ১০ বছরের মধ্যেই ডায়াবেটিস হওয়ার উচ্চ সম্ভাবনা রয়েছে। প্রিয়াডায়াবেটিস হলো রক্তে স্বাভাবিক এর তুলনায় সুগার বেশি কিন্তু ডায়াবেটিস এর তুলনায় কম সুগার থাকা। তাই প্রিয়াডায়াবেটিস কে হালকা ভাবার সুযোগ নেই। প্রিয়াডায়াবেটিস থাকলে তা ওজন কমানো,ব্যায়াম,হাটাহাটি করা, খাবার নিয়ন্ত্রণ করে স্বাভাবিক মাত্রায় নিয়ে আসতে হবে।অন্যথায় হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এসবের ঝুকি আরও বেড়ে যাবে। 

ডায়াবেটিস এর শেষ চিকিৎসা ইনসুলিন :

অনেকেই ভাবেন ডায়াবেটিস রোগীর শেষ চিকিৎসা ইনসুলিন আর যারা ইনসুলিন নেয় তারা এই রোগের চরম পর্যায়ে চলে গেছে। কিংবা তারা অনিয়ম করছে।মুলত এটি ভুল ধারণা। টাইপ-২  ডায়াবেটিস রোগীদের একটা নির্দিষ্ট সময় পরে ইনসুলিন নেওয়ার প্রয়োজন পড়েই।

শুধুমাত্র ঔষধ খেয়ে কিংবা ইনসুলিন ইঞ্জেক্ট করেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রিত করা যায়:

ডায়াবেটিস শুধুমাত্র ইনসুলিন নিয়ে কিংবা শুধুমাত্র ঔষধ খেয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এটাও একটা ভ্রান্ত ধারণা। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে আনতে সুষম খাদ্যাভ্যাস, নিত্যদিন ব্যায়াম,সপ্তাহে ১৫০ মিনিট হাটা এবং নিয়মিত ঔষধ কিংবা ইনসুলিন নেয়া সবগুলোই করতে হবে।এগুলো করলে শরীরে ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়বে,হৃদরোগ এর ও ঝুকি কমবে। তবেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকবে। 

ডায়াবেটিস নিয়ে হাজারো ভ্রান্ত ধারণা আমাদের মধ্যে বিদ্যমান। এসব ভ্রান্ত ধারণা কে দূরে রেখে সাস্থ্যকর খাদ্যভাস মেনে চলে,নিয়মিত ব্যায়াম করে ও নিয়মিত  ঔষধ খেয়ে কিংবা ইনসুলিন নিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে রাখা সম্ভব। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *