ডাবের পানির উপকারিতা ও অপকারিতা এবং খাওয়ার নিয়ম

ডাবের পানির উপকারিতা

“ডাবের পানি”  কথাটি শুনলেই মনে আসে প্রশান্তির ছোঁয়া। অসহ্য গরম, ক্লান্তি ও সারা দিনের পরিশ্রমে শরীর থেকে প্রয়োজনীয় খনিজ লবন বেরিয়ে যায়। এতে শরীর স্বাভাবিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং দেহে অবসাদ চলে আসে। আপনার এই রকম মুহূর্তে  যদি আপনাকে এক গ্লাস ডাবের পানি দেওয়া হয় তাহলে কি করবেন?? অবশ্যই গ্লাস হাতে নিয়ে এক নিঃশ্বাসেই খেয়ে ফেলবেন  তাই না?? কারণ আপনি নিজেও জানেন ডাবের পানি খেলে আপনি কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবেন। এছাড়া আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা ডাবের পানির উপকারিতা ও অপকারিতা এবং খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কে জানেন না। আসুন তাহলে ডাবের পানি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা যাক –

ডাবের পানির উপকারিতা কি?

১. ডিহাইড্রেশন রোধ করে: আমরা যখন পরিশ্রম করি তখন আমাদের শরীর থেকে ঘামের সাথে প্রচুর পরিমাণে পানি বেরিয়ে যায়। এছাড়া অত্যাধিক গরমে শরীর প্রচন্ড ঘেমে যায়। ফলে শরীর থেকে পানি ও খনিজ লবণ বেরিয়ে যায়। এছাড়া বমির কারণেও শরীর পানি শূন্য হয়ে যায়।

এর ফলে শরীরে ডিহাইড্রেশন সমস্যা  শুরু হয়। এ সময় ডাবের পানি খেলে শরীরে পানিশূন্যতা পূরণ হয়। এছাড়া ডাবে আছে কার্বোহাইড্রেট যা শক্তি যোগায়। নিয়মিত ডাব খান এবং ডিহাইড্রেশন রোধ করুন। এছাড়া শীতকালেও নিয়মিত ডাবের পানি পান করা উচিত। 

২. ত্বকের উপকারিতা: ডাবের পানিতে অ্যামিনো এসিড ও শর্করার উপস্থিতির  কারণে শুষ্ক ত্বকের আদ্রতা বজায় রাখার পাশাপাশি ত্বকের পুষ্টিগুণ যোগায়। ত্বক পরিষ্কারের জন্য ডাবের পানি বিশেষত্ব আছে। গবেষকদের গবেষণার প্রমাণিত, ডাবের পানিতে ইলেকট্রোলাইটের উপস্থিতির কারণে ডাবের পানি দিয়ে ত্বক পরিষ্কার করলে ত্বকের মসৃণতা ও উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায়।

এছাড়া ডাবের পানিতে থাকে অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল  উপাদান। মুখে ডাবের পানি ব্যবহার করলে বিভিন্ন উপকারিতা  পাওয়া যায়। ত্বকের কালো দাগ দূর হয়, ব্ল্যাক হেডস, হোয়াইট হেডস, ও ব্রন দূর করতেও সাহায্য করে। কোলাজেন তৈরির পাশাপাশি বলিরেখা কমাতে সাহায্য করে 

৩. কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে: কোষ্ঠকাঠিন্যের অসহ্য  সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে ডাবের পানি পান করুন। ডাবের পানিতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকার কারণে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা সমাধান হয়। দীর্ঘদিন কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা থাকলে পাইলসের ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। নিয়মিত ডাবের পানি পান করুন। 

৪. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ: ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ডাবের পানি বেশ উপকারী। ডাবের পানিতে ম্যাগনেসিয়ামের উপস্থিতির কারণে ইনসুলিন এর কার্যক্ষমতা বেড়ে যায়। এর ফলে গ্লুকোজের মাত্রা  নিয়ন্ত্রণ থাকে। ডাবের পানিতে কোন ফ্যাট নেই এবং ডাবের পানি অতিরিক্ত চিনি শোষণ করে তাই ডাবের পানি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ভালো। ডাবের পানি খেলে ক্ষুধা কম লাগে এবং ক্ষুধা কম লাগার কারণে খাবার কম খাওয়া হয়। এতে করে ওজন বৃদ্ধি হতে রক্ষা পাওয়া যায়। 

৫. হজমে সহায়তা করে: দ্রুত হজম শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য ডাবের পানি পান করুন । কারণ ডাবের পানিতে আঁশ জাতীয় পদার্থ থাকে। হজম শক্তি বৃদ্ধির কারণে শরীরের অতিরিক্ত মেদ ঝরে যায়। তাই সত্যি বিদ্যুতের নিয়মিত ডাবের পানি পান করুন। 

৬. ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণ করে: ব্লাড প্রেসার সমস্যা নিত্যদিনের বিপদজনক সঙ্গী। ব্লাড প্রেসার এর নিয়ন্ত্রণে ডাবের পানি পান করতে পারেন। ডাবের পানিতে ম্যাগনেসিয়াম,পটাশিয়াম, ভিটামিন সি এর উপস্থিতির কারণে ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রিত থাকে। ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রিত না থাকলে বিভিন্ন জটিল রোগের সম্মুখীন হতে হয়। 

৭. হাড় মজবুত করে: মজবুত হার মানেই শক্তিশালী দেহ। দেহের হাড় মজবুত থাকলে কাজের কর্ম দক্ষতা বেশি থাকে। হাড়কে মজবুত ও ভালো রাখার জন্য প্রয়োজন ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম। ডাবের পানিতে এই উপাদান গুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে  পাওয়া যায়। তাই নিয়মিত ডাবের পানি পান করার অভ্যাস করুন এবং হাড়কে রাখুন মজবুত ও শক্তিশালী। 

৮. স্যালাইনের বিকল্প হিসেবে ডাবের পানি: সালাইলে বিকল্প হিসেবে ডাবের পানি পান করা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সৈনিকরা শরীরের কর্মদক্ষতা ও শরীরকে সতেজ রাখার জন্য স্যালাইনের বিকল্প হিসেবে ডাবের পানি পান করতেন। কারণ ডাবের পানির ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, ফাইবার কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করে। প্রাকৃতিক শর্করা ও মিনারেল শরীরের শীতলতায় আদ্রতায় সাহায্য করে। 

৯. শরীরের বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেয়: আমাদের শরীরকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ আক্রমণ করে। এবং সেই বিষাক্ত পদার্থ থেকে একের  অধিক বিষাক্ত পদার্থ তৈরি হয়। নিয়মিত ডাবের পানি পান করলে শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ গুলো বের হয়ে যায়। শরীরের সুস্থতা ও সতেজাতা বজায় থাকে। 

১০. ডায়রিয়া হলে ডাবের পানির উপকারিতা: ডায়রিয়া হলে অতিরিক্ত পাতলা পায়খানা ও বমি হয়। এর ফলে শরীর থেকে পানি ও খনিজ লবণ  বেরিয়ে যায়। এ সময় ডাবের পানি বেশ উপকারী। ডাবের পানি দেহে খনিজ লবণ ও পানির ঘাটতি পূরণ করে। এছাড়া শরীরে ক্যালসিয়াম, পটাশিয়ামের ঘাটতি হলে নিয়মিত ডাবের পানি পান করুন। 

ডাবের পানির অপকারিতা কি? 

উপকারিতার পাশাপাশি ডাবের পানির বিভিন্ন অপকারিতা আছে, জেনে নিন –

  • ডায়রিয়া হলে ডাবের পানি বেশ উপকারী কিন্তু অতিরিক্ত ডাবের পানি আবার ডায়রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। 
  • যাদের ঠান্ডা সর্দি সমস্যা আছে তাদের ডাবের পানি এড়িয়ে চলা উচিত।
  • এলার্জি রোগীদের ডাবের পানি পান করায় সতর্ক থাকতে হবে। কিডনির সুস্থতায় ডাবের পানি বেশ উপকারী কিন্তু কিডনি রোগীদের ডাবের পানি ক্ষতিকর। একজন মানুষের যখন কিডনি রোগ হয় তখন শরীরের পটাশিয়াম বের হয় না। এই অবস্থায় যদি ডাবের পানি পান করা হয় তাহলে ডাবের পানির পটাশিয়াম এবং শরীরের পটাশিয়াম একত্রে কিডনি ফেইলর এর কারণ হতে পারে। 
  • ডাবের পানিতে হাই লেভেলের সোডিয়াম, পটাশিয়াম,  ম্যাগনেসিয়াম থাকে। তাই অতিরিক্ত পরিমাণে ডাবের পানি পান করলে এই উপাদানগুলো পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। ফলশ্রুতিতে ব্লাড প্রেসার অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়বে। 

ডাবের পানি পান করার নিয়ম 

ডাবের পানি পান করার নির্দিষ্ট কোন নিয়ম নেই। তারপরও নিয়মিত কিছু নিয়ম অনুযায়ী পান করলে উপকার পাওয়া যায়।সকালে খাবারের আগে ডাবের পানি পান করুন। এতে হজম শক্তি বৃদ্ধি পাবে। পরিশ্রম করার আগ মুহূর্তে বা পড়ে ডাবের পানি পান করুন ক্লান্তি ভাব দূর হবে এবং শক্তির জোগান হবে। ঘুমোতে যাওয়ার আগে ডাবের পানি পান করতে পারেন এতে শরীর ও মন শান্ত থাকবে ঘুম ভালো হবে। 

গর্ভাবস্থায় কি ডাবের পানি খাওয়া যায়? 

গর্ভাবস্থায় ডাবের পানির কিছু উপকার হয় 

  • ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্যতা  রক্ষা করে 
  • ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণ করে 
  • ভ্রুনের ভিত্তিতে সহায়তা করে (ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম থাকার কারণে) 
  • অতিরিক্ত ওজন কমাতে পারে। 
  • গর্ভাবস্থায় গর্ভবতীর খাবারে সপ্তাহে সর্বনিম্ন ১ দিন এবং সর্বোচ্চ ৩ দিন ডাবের পানি রাখতে হবে। 

তবে গর্ভাবস্থায় ডাবের পানি পান করার ক্ষেত্রে অবশ্যই  চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। 

ডাব খেলে কি গ্যাস হয়? 

“না” ডাবের পানি পান করলে গ্যাস হয় না। বরং প্রতিদিন ডাবের পানি পান করার অভ্যাস করলে এসিডিটি দূর হয়। ডাবের পানি পান করলে পেট ফুলে থাকার সমস্যার সমাধান হয়।

ডাব খেলে কি প্রেসার বাড়ে? 

ডাব খেলে প্রেসার বাড়ে না বরঞ্চ কমে যায়। কারণ ডাবের পানিতে আছে পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং ভিটামিন সি, যা রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। তাই রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত স্বাভাবিক পরিমাণ ডাবের পানি পান করুন। 

ডাবের পানিতে কি এলার্জি আছে? 

ডাবের পানিতে এলার্জি থাকার কোন যুক্তি সঙ্গত প্রমাণ নেই। তবেপরিমিত ডাবের পানি পান করলে এলার্জি হওয়ার সম্ভাবনা কম। তারপরেও কারো যদি ডাবের পানি পান করার পরে এলার্জি সমস্যা দেখা দেয় তাহলে পরবর্তীতে আর ডাবের পানি পান করবেন না। 

জ্বর হলে কি ডাব খাওয়া যাবে? 

“হ্যা” জ্বর হলে ডাবের পানি পান করা যাবে। জ্বর হলে দেহে ডিহাইড্রেশন সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ সময় ডাবের পানি পান করলে ডিহাইড্রেশন রোধ হয়। শরীরের সতেজতা ফিরে আসবে। 

আরও পড়ুন: ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ও ডেঙ্গু জ্বর কত দিন থাকে

কিডনি ভালো রাখতে ডাবের পানি পান করার প্রয়োজনীয়তা 

কিডনি ভালো রাখতে ডাবের পানি পান করার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। ডাবের পানি হচ্ছে এক ধরনের পরিস্কার পদার্থ। ডাবের পানিতে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক পদার্থ থাকার কারণে কিডনিকে পরিষ্কার করে। আমাদেরকে কিডনির নেফ্রনে ক্ষতিকর বজ্রপদার্থ জমে থাকে। ডাবের পানি ক্ষতিকর এই বজ্র পদার্থকে  বের করে দেয় এবং কিডনির প্রক্রিয়া সচল রাখে। কিন্তু কিডনি রোগীদের জন্য ডাবের পানি একবারে নিষিদ্ধ।

যেভাবে ডাবের পানি খেলে ওজন কমবে 

ডাবের পানি ওজন কমাতে সাহায্য করে। ডাবের পানি ইলেকট্রোলাইটের মাত্রা নিয়ন্ত্রিত রেখে ওজন কমাতে সাহায্য করে। ডাবের পানিতে বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানের উপস্থিতির কারণে মেটাবলিজম বৃদ্ধি পায়। ফলে শরীরে বিপাক ক্রিয়া বৃদ্ধির পাশাপাশি অতিরিক্ত ক্যালরি ঝরে যায়। সেই সাথে দেহের ওজনও হ্রাস পায়। 

ডায়াবেটিস থাকলে কি ডাবের পানি খাওয়া যায়? 

ডায়াবেটিসের সমস্যা থাকলে ডাবের পানি কোন প্রভাব ফেলবে না। ডাবের পানিতে কোন ফ্যাট না থাকার কারণে ডাবের পানি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ভালো। এছাড়া ডাবের পানির ম্যাগনেসিয়াম ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে। 

ডাব খেলে কি ডায়াবেটিস বাড়ে?

ডাব খেলে ডায়াবেটিস বাড়ে না কারন ডাবের মধ্যে চিনি থাকে না। বরং ডাব খেলে ডায়াবেটিস রোগী ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। 

ডাবের পানি ফ্রিজে রেখে খাওয়া যাবে? 

ডাবের পানি বেশিদিন ফ্রিজে রেখে খাওয়া ঠিক নয়। ডাবের পানি ফ্রিজে রাখলে ২৪ ঘন্টার মধ্যেই খেতে হবে। 

হাসপাতালে ডাব নিয়ে প্রবেশ নিষেধ কেন? 

হাসপাতালের ডাব নিয়ে প্রবেশ নিষেধ। কারণ ডাবের জলে নেশা জাতীয় বা মাদকদ্রব্য মিশিয়ে সহজেই ভিতরে প্রবেশ করা যায়। এই কারণে হাসপাতালে ডাব নিয়ে প্রবেশ নিষেধ। মনের ভুলেও কখনো এই কাজ করবেন না কেউ। 

মন্তব্য:

এতক্ষণ আমরা ডাবের পানির উপকারিতা ও অপকারিতা এবং ডাব খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কে আলোচনা করলাম।  এছাড়া ডাবের আরো বিভিন্ন প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। লেখায় যদি কোন ভুল ত্রুটি হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই আমাদের জানাবেন। এছাড়া আপনাদের যদি আরো কোন প্রশ্ন থাকে বা কিছু জানার থাকে অবশ্যই আমাদের কমেন্ট করবেন আমরা গুরুত্ব সহকারে আপনার প্রশ্নের উত্তর দিব। 

খাদ্য ও পুষ্টি নিয়ে আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *