মানুষের স্বাস্থ্যের উপর বায়ু দূষণের প্রভাব

মানুষের স্বাস্থ্যের উপর বায়ু দূষণের প্রভাব

আজকাল বায়ু দূষণ একটি বড় সমস্যা হয়ে উঠেছে, এবং এর প্রভাব আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করছে। শহর থেকে গ্রাম সবখানেই বায়ু দূষণ ছড়িয়ে পড়েছে। শহরের বাতাসের ধোঁয়া বা গ্রামে ধূলিকণার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় আমরা সবাই কোন না কোনভাবে এর শিকার হচ্ছি। কিন্তু, আপনি কি জানেন, এই দূষিত বাতাস সরাসরি আপনার স্বাস্থ্যের উপর কীভাবে প্রভাব ফেলে? এই প্রভাব আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য কতটা বিপজ্জনক এই লেখায় আমরা বিস্তারিত জানব মানুষের স্বাস্থ্যের উপর বায়ু দূষণের প্রভাব, এর স্বাস্থ্যঝুঁকি, এবং কীভাবে আমরা এ থেকে রক্ষা পেতে পারি। চলুন জেনে নেওয়া যাক।

বায়ু দূষণের ফলে কী হয়?

দূষিত বাতাসে শ্বাস নেওয়ার ফলে শরীরে বিষাক্ত পদার্থ প্রবেশ করে, যা বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। কিছু সমস্যা স্বল্পমেয়াদী হতে পারে, আবার কিছু দীর্ঘমেয়াদী হয়ে ফুসফুস ও হৃদযন্ত্রের জন্য মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে । দূষিত বায়ুর কারণে মানবদেহে যে সমস্যা দেখা দিতে পারে।

শ্বাসকষ্ট ও হাঁপানি

দূষিত বায়ুর কারণে শ্বাসকষ্ট ও হাঁপানির সমস্যা বেড়েই চলেছে। আপনার গ্রাম ও শহরে রাস্তাঘাটে, যানবাহনে চলাচল করার সময় নাক মুখ দিয়ে ধুলাবালি যাওয়ার কারণে শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে।

ঢাকায় গাড়ির ধোঁয়া, নির্মাণস্থলের ধুলাবালি ও ইটভাটার কালো ধোঁয়া এই সমস্যাগুলোকে আরও গুরুতর হয়েছে। যাদের আগে থেকেই অ্যালার্জি বা অ্যাজমা আছে, তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাই আপনারা রাস্তাঘাটে বের হওয়ার সময় মাস্ক পরিদান করবেন।

একজন রিকশাচালক বলছিলেন, সারাদিন রাস্তায় থাকার কারণে তার প্রায়ই শুকনো কাশি ও শ্বাসকষ্ট হয়। তিনি বলেন, সারাদিন ধোঁয়া আর ধুলাবালির মধ্যে থাকি, রাতে গলা এত শুকিয়ে যায় যে কথা বলতে কষ্ট হয়।

চোখ ও ত্বকে জ্বালাপোড়া

বিশেষ করে শহরাঞ্চলে যেখানে বায়ুতে ধুলো, কল কারখানার ধোঁয়া ও রাসায়নিক দূষক বেশি থাকে। সেখানকার বাসিন্দারা প্রায়ই চোখে জ্বালাপোড়া, লালচে ভাব, অ্যালার্জি ও ত্বকের নানা সমস্যায় পড়েন। ঢাকার মতো বায়ু দূষিত শহরে বসবাসকারী অনেক মানুষ অভিযোগ করেন যে বাইরে বের হলে তাদের চোখ চুলকায় ও লাল হয়ে যায়।

ফ্যাক্টরি বা যানবাহনের ধোঁয়ার সংস্পর্শে যারা প্রতিদিন কাজ করেন, তাদের ত্বকে র‍্যাশ বা অ্যালার্জির সমস্যা দেখা যায়। এছাড়াও, যারা বাইরের দূষিত পরিবেশে দীর্ঘসময় কাটান, যেমন রাস্তায় কাজ করা শ্রমিক বা ট্রাফিক পুলিশ, তাদের চোখ ও ত্বকে সমস্যা বেশি দেখা যায়। আপনার আশেপাশে কেউ যদি এই সমস্যায় ভোগে, তাহলে তাদেরকে পরামর্শ দিন যেন তারা সানগ্লাস, মাস্ক ব্যবহার করেন এবং ত্বক পরিষ্কার রাখেন।

মাথাব্যথা ও ক্লান্তির বাস্তব অভিজ্ঞতা

একজন অফিসগামী ব্যক্তি, যিনি মতিঝিল থেকে উত্তরা যাতায়াত করেন বলছিলেন প্রতিদিন ট্রাফিক জ্যামে বসে থাকা, গাড়ির ধোঁয়া শ্বাস নেওয়া, এবং তীব্র রোদে দাঁড়িয়ে থাকা আমার জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিকেলের দিকে মাথাব্যথা শুরু হয়, আর বাসায় ফিরতে ফিরতে এত ক্লান্ত লাগে যে কিছুই করতে ইচ্ছা করে না।

কখনো আপনার যদি এবং শরীরেও ক্লান্তি অনুভব হয়। চেষ্টা করুন – পর্যাপ্ত পানি পান করুন, বিশ্রাম নিন, ও দূষিত বাতাস এড়িয়ে চলুন, মাস্ক ব্যবহার করুন। যদি সমস্যা বাড়তে থাকে, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। 

সর্দি-কাশির বাস্তব অভিজ্ঞতা

ঢাকায় বসবাসের কারণে অনেকেই বছরের বেশিরভাগ সময় সর্দি-কাশি, শ্বাসকষ্ট, ও গলা ব্যথার সমস্যায় ভোগেন। বিশেষ করে শীতকালে দূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় অনেক মানুষ দীর্ঘমেয়াদি সর্দি কাশিতে আক্রান্ত হন।

আমার এক পরিচিতজন, যিনি মোহাম্মদপুর এলাকায় থাকেন, শীতকালে প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে গলা শুকিয়ে যাওয়া, কাশি এবং সর্দির সমস্যায় ভোগেন। বাইরে বের হলে ধুলাবালির কারণে তার চোখ জ্বালাপোড়া করে ও নাক বন্ধ হয়ে যায়। মাস্ক ছাড়া বের হলে সমস্যা আরও বেড়ে যায়।

বায়ু দূষণ এবং এর স্বাস্থ্যঝুঁকি

বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের মতো শিল্প এলাকা, মারাত্মক ভাবে বায়ু দূষিত হয়। দূষিত বায়ুর কারণে মানবদেহে দীর্ঘমেয়াদী সমস্যার দেখা দিতে পারে। সময়মতো চিকিৎসা না করলে মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। তাহলে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাগুলো জেনে নিন এখনই সতর্ক হোন।

ফুসফুসের রোগ

ফুসফুসের রোগ এখন বাংলাদেশে খুব সাধারণ হয়ে গেছে, বিশেষ করে শহরের ধুলাবালি আর গাড়ির ধোঁয়ার কারণে। নিয়মিত দূষিত বাতাসে শ্বাস নেওয়া ব্রঙ্কাইটিস, অ্যাজমা, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (COPD) সৃষ্টি করতে পারে। যারা ইটভাটা, গার্মেন্টস বা রাস্তার ধুলাবালির মধ্যে বেশি থাকেন, তাদের ঝুঁকি আরও বেশি।

হৃদরোগ

হৃদরোগ বর্তমানে বাংলাদেশে একটি বড় স্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে বয়স, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, এবং মানসিক চাপ হৃদরোগের প্রধান কারণ। দূষিত বাতাসের কারণে হৃদপিণ্ডের কার্যকারিতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। কারণ দূষিত বাতাস শিরার এবং রক্তনালীর উপর চাপ তৈরি করে।

যারা অধিক তেল, চিনি ও প্রক্রিয়াজাত খাবার খান, তাদের মধ্যে হৃদরোগের ঝুঁকি বেশি থাকে। পাশাপাশি ধূমপান, মদ্যপান এই সমস্যাগুলো বাড়িয়ে তোলে।

ক্যানসার

বায়ু দূষণ একটি মারাত্মক সমস্যা, যা সরাসরি ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। দূষিত বাতাসে থাকা কেমিক্যাল, ধূলিকণা, এবং ক্ষতিকর গ্যাস শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করে, যা ফুসফুসের ক্যানসারসহ অন্যান্য শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

আর ও পড়ুন: বায়ু দূষণের ১০টি কারণ ও প্রতিকার

শিশুর বিকাশজনিত সমস্যা

শিশুরা যখন দূষিত বাতাসে খেলাধুলা করে দীর্ঘসময় থাকে তখন তাদের শ্বাসকষ্ট, কাশি, হাঁপানি, এবং অ্যালার্জি সমস্যা দেখা দিতে পারে। শিশুদের শ্বাসতন্ত্র এখনও পুরোপুরি গঠিত হয়নি, তাই তারা বায়ু দূষণ থেকে খুব সহজেই আক্রান্ত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু দূষিত পরিবেশে বেড়ে ওঠে, তাদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কমে যেতে পারে এবং পড়াশোনায় মনোযোগের অভাব হয়।

যখন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে?

যদি আপনি দূষিত বাতাসে দীর্ঘ সময় থাকেন তাহলে আপনার কিছু সমস্যা হতে পারে, যেমন শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা বা হাঁপানি। এই ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। বিশেষ করে, যাদের হৃদরোগ বা শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা রয়েছে, তাদের নিয়মিত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা উচিত।

বায়ু দূষণ সম্পর্কে তথ্যসূত্র

বায়ু দূষণের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইট দেখতে পারেন।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQs)

বায়ু দূষণের সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব কী?

বায়ু দূষণের সবচেয়ে ক্ষতিকর সমস্যাগুলো হল ফুসফুসের রোগ, হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি এবং ক্যানসারের মতো গুরুতর সমস্যা তৈরি করতে পারে।

কোন বয়সের মানুষের জন্য বায়ু দূষণ সবচেয়ে ক্ষতিকর?

বায়ু দূষণ শিশু, বৃদ্ধ ও শ্বাসকষ্টজনিত মানুষের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর।

কোন শহরগুলোতে বায়ু দূষণের মাত্রা বেশি?

ঢাকা, দিল্লি, বেইজিং এবং লাহোরের মতো শহরগুলো দূষণের দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে।

বায়ু দূষণ কি কমানো সম্ভব?

হ্যাঁ, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দূষণ কমানো সম্ভব।

বায়ু দূষণের কারণে পৃথিবীতে প্রতি বছর কত মানুষ মারা যায়?

২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী, পৃথিবীজুড়ে বায়ুদূষণের কারণে প্রায় ৭ মিলিয়ন মানুষ মারা গেছে।

উপসংহার

বায়ু দূষণ শুধু পরিবেশের জন্যই নয়, বরং আমাদের স্বাস্থ্যের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর।। একে উপেক্ষা করলে ভবিষ্যতে আরও বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব পরিবেশ রক্ষা করা এবং দূষণ প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া। আমাদের ছোট ছোট পদক্ষেপের মাধ্যমে পরিবেশের মান উন্নত করা সম্ভব।সুতরাং, আমরা যদি সচেতন হই এবং সরকার সঠিক পদক্ষেপ নেয় তবে দূষণ কমাতে এবং সুস্থ পরিবেশ তৈরি করতে পারব।

আরও পড়তে পারেন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *