বর্তমান বিশ্বে খাদ্যাভ্যাসের স্বাদ পরিবর্তনে, খাদ্যের মাত্রায়  আকর্ষণীয়তা যোগ করতে দৈনন্দিন জীবনে রান্নার কাজে আমরা বিভিন্ন ধরনের তেল ব্যবহার করে থাকি। তেল ছাড়া রান্নার কাজ কল্পনা করা যায় না এবং প্রতিটা খাবার এই কমবেশি তেল ব্যবহার করা হয়। তরকারিতে কেউ সরিষার তেল ব্যবহার করেন, কেউ সয়াবিন তেল ব্যবহার করেন, আবার কেউ ব্যবহার করেন জলপাইয়ের তেল বা অলিভ অয়েল। তবে এসব তেলের মধ্যে সবচেয়ে স্বাস্থ্য উপকারী তেল হচ্ছে অলিভ অয়েল। 

অলিভ অয়েলের উপকারিতা সম্পর্কে যারা জানেন না, অলিভ অয়েলের গুনাগুন সম্পর্কে যারা জানেন না, আমাদের আজকের আর্টিকেলটি শুধুমাত্র আপনার জন্য। আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় অলিভ অয়েল এর উপকার সম্পর্কে এবং বিভিন্ন গুনাগুন সম্পর্কে আলোচনা করা। 

অলিভ অয়েল এর প্রকারভেদ 

অলিভ অয়েলের কিছু প্রকারভেদ আছে 

  • Extra virgin olive oil- (অতিরিক্ত কুমারী অলিভ অয়েল )
  • virgin olive oil (কুমারী অলিভ অয়েল) 
  • Refined olive oil (পরিশোধিত অলিভ অয়েল) 
  • pure olive oil (খাটি অলিভ অয়েল) 

স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অলিভ অয়েল

  1. মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ বন্ধ করে:

বর্তমান সময়ে উচ্চ রক্তচাপের কারণে বিপদজনক হয়ে উঠেছে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ। মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণের ফলে হার্ট অ্যাটাক, ব্রেন স্ট্রোকের মতো বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে অথবা চিরদিনের জন্য প্যারালাইজড হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। গবেষকরা গবেষণা করে দেখেছেন অন্যান্য তেলের চেয়ে জলপায়ের তেল বা অয়েল স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাক এর ঝুঁকি অনেকাংশে কমে দেয়। কারণ মনস্যাচুরেটেড ফ্যাট অলিভ অয়েলের মধ্যে বিদ্যমান থাকায় হৃদরোগের বড় বড় ঝুকি কমে যায়। 

  1. ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ প্রতিহত করে:

 প্রতিদিন আমাদের শরীরে আমাদের নিজের অজান্তে নানা ধরনের ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করে এবং এসব ব্যাকটেরিয়া কারণে আমরা নানাভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। অলিভ অয়েল এর মধ্যে এন্টি ব্যাকটেরিয়াল গুন থাকার কারণে আমাদের দেহের জন্য বিপদজনক ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে। এইজন্য নিয়মিত অলিভ অয়েল বা জলপাইয়ের তেল আমাদের সবার ব্যবহার করা উচিত। 

  1. কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্ত করে:

ছোট, বড়, শিশু, বৃদ্ধ কমবেশি সবারই মাঝে মাঝে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় ভুগতে হয়। এর ফলে শরীরে একটা বিব্রতকর অবস্থায় সৃষ্টি হয়। কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য ওষুধ খেয়ে থাকি কিন্তু মাঝে মাঝে ওষুধে কোন ফল পাওয়া যায় না। কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যার একটা কার্যকরী সমাধান হল জলপাইয়ের তেল নিয়মিত ব্যবহার করা। এতে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। অলিভ অয়েল এ বিদ্যমান ওমেগা ৩, আয়রন,  ভিটামিন ই,কে শরীরে দ্রুত খাবার হজমের পাশাপাশি কোষ্ঠকাঠিন্যের যন্ত্রণা থেকে রক্ষা করে। হালকা গরম এক গ্লাস দুধ ও এক চামচ এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল নিয়মিত খালি পেটে পান করুন কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্তি পাবেন। 

  1. বদহজম থেকে মুক্তি:

অনিয়মিত ও পরিমানের অধিক খাবার খেলে সাধারণত বদহজম হয়ে যায়। যাদের বদ হজম সমস্যাটা নিয়মিত হয়, যে কোন খাবার খেলেই পেট খারাপ হয়ে যায় তারা এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারেন নিয়মিত জলপাইয়ের তেল বা অলিভ অয়েল গ্রহণ করার মাধ্যমে। অলিভ অয়েলের মধ্যে নিহিত মনোসেটুরেটেড ফ্যাট বদ হজমের সমস্যার সমাধান করে। এর জন্য আপনাকে যা করতে হবে, একটি বাটিতে এক চামচ অলিভ অয়েল ও পরিমাণ মতো লেবুর রস মিশিয়ে খেতে হবে। 

  1. নাক ডাকার সমাধান:

নাক ডাকার সমস্যা বিষয়টা কিন্তু হাস্যকর। এটা এমন একটা কাজ যে কাজটা আপনি যখন করেন তখন আপনি জানেনই না যে কাজটা আপনি করতেছেন বা এতে আপনার কোন সমস্যাও হয় না। কিন্তু বিরক্তিকর পরিস্থিতিতে পড়ে যায় আপনার আশেপাশে থাকা ব্যক্তিগুলো। নাক ডাকার সমস্যা সমাধানে প্রতিদিন ঘুমানোর আগে এক চামচ অলিভ অয়েল খান সমস্যার সমাধান পাবেন। 

  1. দুরারোগ্য বা ক্যান্সারের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়:

ক্যান্সারের প্রতিষেধক নেই ক্যান্সারকে প্রতিরোধ করুন। নিশ্চিত মৃত্যু রোগের প্রতিরোধক হিসেবে অলিভ অয়েল উপকারী। জলপাইয়ের তেলে অলোরোপিয়ান নামের প্রাকৃতিক একটি উপাদান নিহিত থাকে যা মহিলাদের স্তন ক্যান্সারের আশঙ্কা কমিয়ে দেয়। 

  1. প্রদাহ বা ব্যাথানাশক হিসেবে কাজ করে:

প্রতিদিনের নিত্য প্রয়োজনীয় কাজের সময় আমরা বিভিন্ন কারণে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা পেয়ে থাকি। এরকম নানা অজাতিত ব্যাথার সমাধান হিসেবে ৪০ ml পানির সাথে ৪ চামচ অলিভ অয়েল মিক্স করে খান প্রদাহ বা ব্যাথা কমে যাবে।

  1. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে:

ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে অলিভ অয়েল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অলিভ অয়েলের মনোস্যাচুরেটেড গ্লুকোজের মাত্রা  কম করে ইনসুলিন বাড়িয়ে দেয়। শরীরে শর্করার মাত্রা কমে যায় এবং ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটা কমে যায়। 

ত্বকের সুরক্ষায় অলিভ অয়েল

  1. ব্রণ বা মেসতা সমস্যার সমাধান:

ধুলাবালির এই শহরে জীবিকার সন্ধানে বা পারিপার্শ্বিক কাজের জন্য প্রতিদিন আমাদের বাহিরে যেতে হয়। পরিবেশ দূষণের কারণে বিভিন্ন ধুলাবালি আমাদের মুখের ত্বকে জমা হয় এবং এর ফলে মুখে ছোট ছোট ব্রণ দেখা দেয়। এটা একটা সবারই কমন সমস্যা। এই ব্রণের সমস্যা থেকে সমাধানের জন্য নিয়ম অলিভ অয়েল তেল ব্যবহার করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। অলিভ অয়েল এর সঙ্গে এক চিমটি লবণ মাখিয়ে মুখে আলতো করে লাগিয়ে দিন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর কুসুম কুসুম গরম পানি দিয়ে পরিষ্কার করুন। এরকম ব্যবহার করলে মুখের ব্রণ সমস্যা সমাধান হয়। 

  1. বার্ধক্য ছাপ দূর করতে:

বয়স এমন একটা জিনিস যা কখনো কমে না, যতই দিন যাচ্ছে বয়স বেড়েই যাচ্ছে সেইসঙ্গে শরীরে বার্ধক্যের ছাপ নেমে আসছে। এর ফলে শরীরের চামড়া কুঁচকে যায়। জলপাইয়ের তেলের সাথে লবণ, লেবুর রস মিশিয়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় মালিশ করুন এবং কিছুক্ষণ পর হালকা গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এতে চামড়া কুচকে যাওয়া রোধ হবে। 

  1. ত্বকের কালো দাগ দূর করা:

রাত জাগার কারণে বা বিভিন্ন কারনে আমাদের অনেকের চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে যায়। একসময় এটা দীর্ঘমেয়াদী হয়ে যায় এবং এই কালো দাগ আর উঠে না।এর জন্য নিয়মিত অলিভ অয়েল ব্যবহারের মাধ্যমে এই কালো দাগ আস্তে আস্তে উঠে যায়। 

  1. ত্বকের সজীবতায়:

বর্তমান সময়ের যত রোগ আছে তার মধ্যে প্রায় 80% রোগ ত্বকের রোগ। ত্বকের রোগ হলে যেমন সজীবতা হারিয়ে যায় শরীরে নানাবীদ সমস্যার সৃষ্টি করে। অলিভ অয়েলের  মধ্যে নিহিত এক্সিডেন্ট গুলো ত্বকের সজীবতায় সাহায্য করে। আমাদের উচিত নিয়মিত জলপাইয়ের তেল বা অলিভ অয়েল ব্যবহার করা। 

  1. পরিছন্ন ত্বক ও ড্যামেজ টিস্যু সঠিক করে :

জলপাইয়ের তেল বা অলিভ অয়েল তত্ত্বকে পরিচ্ছন্ন রাখতে, ত্বকের ড্যামেজ হওয়া টিস্যুকে সঠিকভাবে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। নিয়মিত অলিভ অয়েল ত্বকে  মালিশ করলে ত্বক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে। 

চুলের যত্নে অলিভ অয়েল এর ব্যবহার 

  • ইদানিং প্রত্যেকের একটা কমন সমস্যা হয়ে গেছে মাথায় খুশকি হওয়া। খুশকির কারণে মাথা থেকে চুল ঝরে যাচ্ছে এবং চুল মলিনতা হারাচ্ছে। খুশকির সমস্যায় অলিভ অয়েল তেলের সাথে লেবুর রস মিশিয়ে চুলের গোড়ায় লাগিয়ে দিন এবং একটু পরে হালকা গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এতে খুশকি মুক্ত হবে। 
  • দ্রুত চুলের বৃদ্ধিতে অলিভ অয়েল তেল বেশি উপকার। অলিভ অয়েল তেলের মধ্যে চুলের জন্য প্রয়োজনীয় এন্টিঅক্সিডেন্ট থাকে এর ফলে চুলের গোড়া শক্ত হয়, চুল পড়ে না এবং চুলের উজ্জ্বলতা বজায় থাকে। 

অলিভ অয়েল ব্যবহারের নিয়ম 

অধিক পরিমাণে অলিভ অয়েল ব্যবহার না করে পরিমাণ মতো ব্যবহার করতে হবে। অলিভ অয়েলের নানাবিদ উপকারের জন্য এর ব্যবহার অনেক। বর্তমানে রান্নার কাজ থেকে শুরু করে শরীরচর্চায়, শরীরের স্বাভাবিক সুস্থতায় জলপাইয়ের তেল বা অলিভ অয়েল ব্যবহার করা হয়। অলিভ অয়েল ব্যবহারের সময় অবশ্যই আমাদের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে কারণ অলিভ অয়েলের বাজার মূল্য অনেক বেশি হয় অনেকেই এটার ভেজাল সাপ্লাই করে। 

কিভাবে খাঁটি অলিভ অয়েল চিনবেন? 

অসাধু ব্যবসায়ীদের দ্বারা বর্তমানে অলিভ অয়েলের ভেজালের পরিমাণ প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে অলিভ অয়েল ব্যবহার করে সাধারণ মানুষ  কাঙ্খিত ফলাফল পাচ্ছে না। আপনি যে অলিভ অয়েলটি কিনলেন তা খাটি কিনা বা ভেজাল আছে কিনা তার জন্য আপনাকে যা করতে হবে, একটি পাত্রে কিছু অলিভ অয়েল  তেল নিন এবং পরীক্ষার জন্য রেখে দিন ডিপ ফ্রিজে। ২ ঘন্টা পর বের করে  যদি দেখেন জমে গেছে বা সম্পূর্ণ তেল তরল আছে, তাহলে বুঝতে হবে এই তেলে ভেজাল আছে  তেলটি খাঁটি নয়। কিন্তু হালকা জমে যাওয়া, হালকা ঘন হয়ে যাওয়া, এরকম হলে করতে হবে তেলটি আসল এতে কোন ভেজাল নেই। 

অলিভ অয়েলের অপকারিতা 

প্রত্যেকটি জিনিসের কিছু না কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকে এবং সঠিক নিয়ম ও সঠিক ব্যবহারের ফলে এই পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলো এড়িয়ে চলা যায়। অলিভ অয়েল তেল অধিক পরিমাণে ব্যবহারের ফলে শরীরে কিছু সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। মাত্রাতিরিক্ত অলিভ অয়েল ব্যবহারের ফলে শরীরে এলার্জির পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। এছাড়া শরীর রক্তচাপের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে পারে। এর ফলে শরীরে বড় কোন দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকে। 

বিশেষ দ্রষ্টব্য 

স্বাস্থ্য বিষয়ক আমাদের এই আর্টিকেলটি পড়ার পর এই টিপস গুলো আপনারা বাস্তব জীবনে প্রয়োগের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন। কারন আমাদের কাজ হচ্ছে শুধুমাত্র তথ্য সরবরাহ করা। তাই অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োগ করবেন। 

মন্তব্য 

অলিভ অয়েলের উপকারিতা ও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এতক্ষন আমার আলোচনা করলাম। আশা করি আপনারা সবাই আমাদের আর্টিকেলটি ভালো করে পড়েছেন এবং বুঝতে পেরেছেন। স্বাস্থ্য বিষয়ক অন্যান্য আরও যদি কোন প্রশ্ন আপনাদের মনে থাকে তাহলে অবশ্যই আমাদের কমেন্ট করে জানাবেন আমরা যথাযথভাবে আপনার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ। 

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *