বাদাম খেতে পছন্দ করেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। শারীরিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য, শরীরের পুষ্টির চাহিদা পূরণের জন্য আমাদের নিয়মিত বাদাম খাওয়া প্রয়োজন। বাজারে বিভিন্ন ধরনের বাদাম পাওয়া যায় কাঠবাদাম,  কাজুবাদাম, পেস্তা বাদাম এবং আখরোট। এই বাদামগুলোতে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়।অন্যান্য বাদাম সম্পর্কে আমরা ভালোভাবে জানলেও, আখরোট বাদাম সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না। তো আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়হলো আখরোট বাদাম কি এবং আখরোট এর উপকারিতা ও খাওয়ার উপকারিতা গুলো কি। আখরোট বাদাম সম্পর্কে আপনাদের বোঝার সুবিধার্থে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব চলুন শুরু করা যাক-

আখরোট কি ?

আখরোট একটি ফল, যা বাদাম জাতীয় ফলের অন্তর্ভুক্ত। আখরোটে গাছের বৈজ্ঞানিক নাম জুগলান্স রেজিয়া। এই ফলের মধ্যে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান গুলো ভরপুর। আখরোট বাদামের ওপরে যে বাদামী রঙের আবরণ থাকে তাই এন্টিঅক্সিডেন্ট এ ভরপুর। পুষ্টিতে ভরপুর আখরোট ফলে পাওয়া যায় আমিষ ও গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাটি অ্যাসিড। 

আখরোটের পুষ্টি উপাদান

আখরোট বাদামের বিভিন্ন পুষ্টি  উপাদান

  • শক্তি –২৭৩৮ কিজু অথবা ক্যালরি– ৬৫৪
  • কার্বোহাইড্রেট – ১৩.৭১ 
  • ফাইবার — ৬.৭
  • স্নেহ পদার্থ–—  ৬.১২ 
  • ভিটামিন এ –— ২০ আই ইউ 
  • বিটা ক্যারোটিন —- ১২ মাইক্রো গ্রাম
  • লুটিন জিয়াক্সানথিন –—৯  মাইক্রোগ্রাম 
  • প্রোটিন –— ১৫.২৩ 
  • ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড ––৩.৩৪৬
  • থায়ামিন বি১— ০.৩৪১ মিলিগ্রাম 
  • নায়াসিন বি৩ –— ১.১২৫ মিলিগ্রাম 
  • ভিটামিন বি ৬ –—০.৫৩৭ মিলিগ্রাম 
  • ফোলেট–— ৯৮ মাইক্রগ্রাম 
  • ভিটামিন সি –— ১.৩ মিলিগ্রাম 
  • ভিটামিন কে –—২.৭ মাইক্রো গ্রাম  
  • ক্যালসিয়াম –—৯৮ মিলিগ্রাম 
  • পটাশিয়াম– ৪৪১ মিলিগ্রাম 
  • ফসফরাস –৩৪৬ মিলিগ্রাম 
  • ম্যাগনেসিয়াম –১৫৮ মিলিগ্রাম 
  • লৌহ  –২.৯১ মিলিগ্রাম 
  • সোডিয়াম  –২ গ্রাম
  • জিংক– ২.০৯ মিলিগ্রাম। 
  • পানি  –৪.০৭ 

আখরোট এর উপকারিতা

অত্যাধিক পুষ্টি সমৃদ্ধ আখরোটের বিভিন্ন উপকারিতা আছে। নিয়মিত আখরোট খাওয়া শরীরের জন্য খুবই উপকারী। 

১. হার্ট সুস্থ রাখে

হার্টের সুস্থতার জন্য জন্য নিয়মিত আখরোট খাওয়া প্রয়োজন। সুস্থ হার্ট, সুস্থ দেহ, সুস্থ মন ও সুন্দর জীবন যাপন সবারই একান্ত কাম্য থাকে। কিন্তু এই হার্টের সুস্বাস্থ্যের জন্য আমাদের কত কিছুই না খাওয়া দরকার। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটা ফল হল আখরোট বাদাম। আখরোট বাদামের মধ্যে ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায় যা আমাদের কার্ডিও সিস্টেমের সক্রিয়তা বজায়  রাখে। 

একটি দেহের প্রধান অংশ হচ্ছে হার্ট। কিন্তু সেই হার্ট যদি বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন রোগ দ্বারা আক্রান্ত হয়, তাহলে দেহের অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গুলো ধীরে ধীরে স্বাভাবিক ক্রিয়া বন্ধ করে দেয়। একটি কম্পিউটারের প্রাণ হিসেবে যেমন মাদারবোর্ড কে বিবেচনা করা হয় ঠিক তেমনি মানবদেহের প্রাণ হলো হার্ট। আখরোট বাদামের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, এবং নায়াসিন বি৩ পাওয়া যায়। এগুলো হার্ট কে বিভিন্ন ধরনের কার্ডিওলজি সমস্যা থেকে রক্ষা করে এবং হার্টকে রাখে সুস্থ। 

২. ত্বকের উজ্জলতায় সাহায্য করে 

একটি দেহের প্রাচীর হচ্ছে ত্বক। এই ত্বক বাইরের রোগ জীবাণু থেকে দেহ কে রক্ষা করার পাশাপাশি দেহের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।   কিন্তু যখন ত্বক নিজেই বিভিন্ন রোগ জীবাণুর দ্বারা আক্রমণ হয় তখন ত্বকে  বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়। নিয়মিত আখরোট বাদাম  খাওয়ার ফলে ত্বকের মলিনতা, সজীবতা বৃদ্ধি পায়। আখরোট বাদামে প্রচুর ক্যালসিয়াম, ভিটামিন সি, ফোলেট আছে। যার যার কারণে ত্বকের কোষের স্বাভাবিক ক্রিয়া ঠিক থাকে। 

সাধারণত ত্বকে যখন ফ্রি রেডিক্যাল ড্যামেজ হয় তখন ত্বকের মধ্যে বলি রেখার সমস্যা দেখা দেয়। সাধারণত বয়স হওয়ার সাথে সাথে ফ্রি রেডিক্যাল ড্যামেজ শুরু হয়। আখরোটের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ভিটামিন ডি ত্বকের এই ফ্রি রেডিক্যাল ড্যামেজ সমস্যা থেকে রক্ষা করে। নিয়মিত আখরোট খাওয়ার অভ্যাস করলে ত্বকের বলিরেখা দূর হয়, ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায়। 

৩. যৌনশক্তি ও শুক্রানুর সংখ্যা বৃদ্ধিতে 

যৌন শক্তি বাড়াতে এবং শুক্রাণুর মান ঠিক রাখতে আখরোট বাদাম ভালো উপকার দেয়। সন্তান জন্মদানের প্রধান উপাদান শুক্রাণু, তাই শুক্রানুর মান ঠিক রাখতে নিয়মিত আখরোট বাদাম খেতে হবে। বর্তমানে যৌন সমস্যা ঘরে ঘরে এবং এর কারণে ভেঙ্গে যাচ্ছে অনেক সংসার। যৌন সমস্যার কারণে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে অনেক মানুষ। যৌন শক্তি বাড়ানোর জন্য আখরোট খেতে  পারেন। প্রতিদিন মধু ও আখরোট একসঙ্গে খেলে শুকানোর সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং শুকানোর মান ঠিক থাকে এবং যৌন শক্তি বৃদ্ধিতেও ভালো কাজ হয়। 

৪. চুলের উপকারে

বর্তমান সমাজে আমরা সবাই একটা সাধারণ সমস্যা লক্ষ্য করি, চুল পড়ে যায়, মাথায় খুশকি, চুলের বৃদ্ধি কমে যাওয়া ইত্যাদি। এই সমস্যাগুলো আমাদের প্রতিনিয়ত সবাইকেই ফেস করতে হয়। চুলের সমস্যা রোধ করার জন্য আমরা প্রতিদিন নানান রকম কিছু করি কিন্তু কোন কিছুতেই ভালো ফলাফল পাইনা। তো চুলের এইসব সমস্যা সমাধানে আখরোট বাদাম হতে পারে দুর্দান্ত।

কারণ আখরোট বাদামে পাওয়া যায় ভিটামিন বি ৭ বা বায়োটিন। যার চুলের এলোমেলো ভাব দূর করে চুলকে সোজা রাখতে সাহায্য করে। এ ছাড়া  চুল পড়া বন্ধ করতে সাহায্য করে। আখরোটে ভিটামিন সি এবং ক্যালসিয়াম থাকার কারণে চুলের গোড়া মজবুত ও শক্তিশালী হয়। এছাড়া মাথার খুশকি দূর হয়। 

৫. মানসিক বিকাশে সহায়তা করে 

আখরোটে পাওয়া যায় ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড যা মানব দেহের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মস্তিষ্ককে উন্নত রাখতে,  মস্তিষ্কের বিকাশে আখরোটের ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই মস্তিষ্কের সুস্থতায়,  মস্তিষ্কের বিকাশে ডায়েটে নিয়মিত আখরোট বাদাম খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। 

৬. ক্যান্সার প্রতিরোধ করে 

ক্যান্সার, ভয়ংকর এই রোগটির প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে আখরোট বাদাম। পলিফেনলস, ইউরিথিলিন এন্টি অক্সিডেন্ট, ওমেগা থ্রি আখরোট বাদামে বিদ্যমান  থাকায় ক্যান্সার প্রতিরোধী হিসেবে সাথে কাজ করে। 

৭. কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখে 

কোলেস্টেরলের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ থাকা মানব দেহের জন্য খুবই ভালো দিক। কোলেস্টরেলের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে থাকলে দেহের প্রধান অঙ্গ হার্ট সুস্থ থাকে এবং হার্টের বিভিন্ন রোগ হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম থাকে। গবেষণায় প্রমাণিত হয় যে, অন্যান্য সময়ের চাইতে আখরোট বাদাম খাওয়ার ফলে দেহের কোলেস্টেরলের পরিমাণ দ্রুত কমতে থাকে যা মানব দেহের জন্য পজিটিভ দিক। আখরোট বাদাম কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ রাখার পাশাপাশি রক্তের ভেসেলের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ রাখে এবং নমনীয়তা বজায় রাখে। 

৮. স্মৃতিশক্তি ভালো রাখে 

স্মৃতিশক্তি ভালো রাখতে আখরোট বেশ দারুন একটি ফল। মানুষের স্মৃতিশক্তি নষ্ট হওয়ার প্রধান কারণ হলো রক্তে থাকা ফ্রি রেডিক্যাল রাসায়নিক এবং রোগ টির নাম ডিমেনশিয়া। এই সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারে ভিটামিন ই এবং ফ্লাভোনয়েড। আর গুরুত্বপূর্ণ উপাদান গুলো পাওয়া যায় আখরোট বাদামে। নিয়মিত আখরোট বাদাম খাওয়ার অভ্যাস করলে স্মৃতিশক্তি ভালো থাকে। 

আখরোট খাওয়ার নিয়ম 

আখরোট খাওয়ার তেমন কোন নিয়ম নাই। যেকোনো সময় খাওয়া যায়। তারপর ও যেভাবে আখরোট খাবেন ভালো উপকার পাবেন –

  • রাতে পাঁচ ছয়টি আখরোট পানিতে ভিজিয়ে রাখুন সকালবেলা পরিষ্কার করে খেয়ে ফেলুন। এতে ভালো উপকার পাওয়া যায়। খাদ্য আশ থাকার কারণে হজম শক্তি বৃদ্ধি পায়। 
  • দুধের মধ্যে আখরোট চুবিয়ে সকাল অথবা বিকেলে খাওয়া যায়। এছাড়া মধুর সঙ্গে আখরোট খেলে দেহে শুক্রাণু সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ও মান ঠিক রাখে। 

আখরোট কোথায় পাওয়া যায় 

আখরোট উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশের আবহাওয়া উপযুক্ত নয়। এজন্য বাংলাদেশে আখরোট এ-র সাপ্লাই কম । তবে বিভিন্ন বড় বড় সুপার শপগুলোতে আখরোট পাওয়া যায়। 

আখরোটের দাম 

আখরোটের দাম নির্ধারণ হয় এর মানের ওপর 

  • ভালো মানের আখরোট ––২০০০ টাকা কেজি
  • মধ্যম মানের আখরোট –— ১০০০/১৫০০ টাকা কেজি
  • নিম্ন মানের আখরোট –— ৫০০-১০০০ টাকা কেজি

আখরোট ও মধুর উপকারিতা 

মধু যেমন বহুগুন সমৃদ্ধ তেমনি আখরোটের মধ্যে আছে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি উপাদান।  আখরোট ও মধু একসঙ্গে খেলে দেহে শুক্রাণুর গুণগত মান ঠিক থাকে এবং শুকানোর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া যৌন শক্তি বৃদ্ধিতেও সাহায্য করে। 

প্রতিদিন কয়টি করে আখরোট খাওয়া উচিত? 

গবেষণায় প্রমাণিত, প্রতিদিন তিন থেকে চারটি করে আখরোট খেলে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের সমস্যার সমাধান হওয়ার পাশাপাশি টাইপ ২ ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। 

আখরোটের অপকারিতা

  • বেশি খেলে বদহজম হতে পারে 
  • এলার্জিজনিত সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে 
  • ফাইটেটসের কারনে শরীরে আয়রনের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। কারণ ফাইটেটস আয়রন শোষণ করে। 
  • লিভারের ক্রিয়া জনিত সমস্যা হতে পারে 
  • ত্বকের মধ্যে ফুসকুড়ি, চুলকানি হতে পারে। 

মন্তব্য

আমরা আশা করি আমাদের আলোচনার মাধ্যমে আপনারা ভালভাবে আখরোটের উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি। যদি কোন ভুল ত্রুটি হয় তাহলে অবশ্যই আমাদের জানাবেন এবং যদি আরো কোন প্রশ্ন থাকে আমাদের কমেন্ট করে জানাবেন। ধন্যবাদ।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *