রসে ভরপুর, স্বাদে অনন্য, পুষ্টিতে পরিপূর্ণ একটি ফল হলো “আনারস”। আনারস বহুগুণ সমৃদ্ধ একটি ফল। আনারস খেতে যেমন স্বাদের প্রশান্তি পাওয়া যায় তেমনি আনারস দেহের বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের কেন্দ্রবিন্দু। আজকে আলোচনার বিষয় আনারস খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা নিয়ে। অনেকে আছেন যারা আনারসের এই বিষয়গুলো সম্পর্কে জানেন না। তো অযথা কথা না বাড়িয়ে চলুন শুরু করা যাক –

আনারস সম্পর্কে আলোচনা 

আনারস বা পাইন আপেলের বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে “অ্যানানাস কমোসাস”। দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশকে আনারসের জন্মস্থল হিসেবে ধরা হয়। সারা বিশ্বের যত আনারস উৎপাদিত হয় আর তিন ভাগের একভাগ আনারস উৎপাদিত হয় ফিলিপাইন, কোস্টারিকা ও ব্রাজিলে। আনারস গাছ গুচ্ছফল যুক্ত মাঝারি সাইজের একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ। 

আনারসের পুষ্টি উপাদান 

আনারসের মধ্যে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান আছে।  ১০০ গ্রাম এ পুষ্টির গুনগত মান..

  • ভিটামিন সি – ৪৭.৮ মিগ্রা.
  • শর্করা –  ১৩.১২ গ্রাম।
  • চিনি –  ৯.৮৫ গ্রা.
  • ক্যালসিয়াম – ১৩ মিগ্রা.
  • ম্যাগনেসিয়াম – ১২ মিগ্রা.
  • ম্যাঙ্গানিজ —- ০.৯২৭ মিগ্রা.
  • পটাশিয়াম –  ১০৯ মিগ্রা.
  • ফসফরাস —- ৮ মিগ্রা.
  • পানি ––৮৬ গ্রা.
  • কোলিন – ৫.৫ মিগ্রা.
  • ভিটামিন বি ৬–. ১১২ মিগ্রা.
  • প্যানটোথেনিক এসিড -. ২১৩ মিগ্রা.
  • প্রোটিন — . ৫৪ গ্রা.

এছাড়া আরো আছে থায়ামিন বি১, রিবোফ্লাভিন বি২, নায়াসিন বি৩, লৌহ, সোডিয়াম, জিংক ইত্যাদি। 

আনারস খাওয়ার উপকারিতা 

১. চোখের সুরক্ষায়: ম্যাক্যুলার ডিগ্রেডেশন হলো ধীরে ধীরে দৃষ্টি শক্তি কমিয়ে অন্ধ হওয়ার মত অবস্থা সৃষ্টিকারী চোখের একটি মারাত্মক রোগ। এই রোগটি চোখের রেটিনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এর ফলে দৃষ্টি শক্তি আস্তে আস্তে কমতে থাকে। এর ফলে ঝাপসা দেখা, পরিচিত মুখ চিনতে না পারা এবং পড়াশোনায় সমস্যা হয়। এই রোগটি থেকে পরিত্রাণের জন্য আনারস খাওয়া একান্ত প্রয়োজনীয়। আনারসে বিদ্যমান বিটা ক্যারোটিন চোখের এই সমস্যা থেকে রক্ষা করে। নিয়মিত আনারস খেলে ম্যাক্যুলার ডিগ্রেডেশন হওয়ার সম্ভাবনা ১০০ শতাংশের মধ্যে ৩০ শতাংশ কমে যায়। 

২. পুষ্টিহীনতা দূর করে: পুষ্টিহীনতার অভাবে দেহে বিভিন্ন ধরনের রোগের উদ্ভব হয়। ফলে দেহের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। পুষ্টিহীনতা দূর করতে আনারসের  বিকল্প নেই। আনারসের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পুষ্টি উপাদান( ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ভিটামিন বি৬, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি ) থাকার কারণে তা দেহের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে এবং দেহের স্বাভাবিক ক্রিয়ায় সহায়তা করে। 

৩. হজম শক্তি বৃদ্ধি করে: দেহে হজম শক্তির সমস্যা হলে সব কিছুই গোলমাল হয়ে যায়। হজম শক্তি বৃদ্ধিতে আনারস খেলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। আনারসের ব্রোমেলিন নামক এনজাইমের উপস্থিতির কারণে হজম শক্তি উন্নত হয় এবং বদহজমের সমস্যার সমাধান হয়। তাই আনারস খান পেটের পীড়া, বদহজম দূর করুন,  সাথে হজম শক্তি বৃদ্ধি করুন। 

৪. দাঁতের সুরক্ষায়: দাঁতের সুরক্ষায় আনারসের জুরি নেই। দাঁতের সুরক্ষায় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ক্যালসিয়াম। আর এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি আনারসে পাওয়া যায়। প্রতি ১০০গ্রাম আনারসে ১৩ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়। এই ক্যালসিয়াম দাঁতের সুরক্ষায় কাজ করে এবং দাঁতের মাড়ির বিভিন্ন ধরনের সমস্যা(দাঁতের মাড়ি ফুলে যাওয়া, দাঁতে ব্যথা হওয়া)  সমাধান করে। এছাড়া রোগ জীবাণুর  সংক্রমণ থেকে দাঁত কে রক্ষা করে দাঁতকে অনেকটা সুরক্ষা দেয়। এছাড়া আনারসে বিদ্যমান এন্টিফ্লামেটরির উপস্থিতির কারণে শরীরের ব্যথা কমে যায়। 

৫. ত্বকের সুরক্ষায়: ত্বকের সুরক্ষায় আনারস ভালো ফলাফল প্রদান করে। আনারসে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে পাওয়া যায় ভিটামিন সি। ১০০ গ্রাম পরিমাণ আনারসে ভিটামিন সি পাওয়া যায় ৪৭.৮ মিলিগ্রাম। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ভিটামিন সি ত্বকের সুরক্ষায় বেশ বড় ভূমিকা পালন করে। ত্বকের উজ্জ্বলতা, মসৃণতা, তারুণ্যতা ধরে রাখে ভিটামিন সি। ভিটামিন সি এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বককে ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে। এছাড়া ত্বকের তৈলাক্ততা, ব্রণ, কালো দাগ দূর করতে আনারস বেশ উপকারী। 

৬. হাড় গঠনে সাহায্য করে: আনারসে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম থাকার কারণে হাড়কে শক্তিশালী ও মজবুত করতে সাহায্য করে। হাড় শক্তিশালী ও মজবুত থাকলে দেহের কার্য ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া আনারসে পাওয়া যায় ম্যাঙ্গানিজ। যা দেহের হাড়কে মজবুত করে। যেসব ব্যক্তি হাড়ের সমস্যায় ভোগতেছেন তারা খাদ্য তালিকায় নিয়মিত আনারস রাখতে পারেন। নিয়মিত পরিমিত পরিমাণে আনারস খেলে হাড়ের যেকোন সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়। 

৭. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে: আনারস বা আনারসের জুস ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। বর্তমান সময়ের একটা প্রচলিত সমস্যা হলো ওজন বৃদ্ধি পাওয়া। এরফলে  অতিরিক্ত ওজনের কারণে শরীরে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হয়। কিন্তু আনারস এই  সমস্যার সমাধান করতে পারে। আনারসে কম পরিমাণে ফ্যাট এবং প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকার কারণে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে। নিয়মিত আনারসের  সালাত বা জুস খেতে পারেন। শরীর স্বাস্থ্য ভালো থাকবে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকবে। 

৮. ক্যান্সার প্রতিরোধে: বর্তমান সময়ের সবচেয়ে কঠিন ও জটিল অসুখ হলো ক্যান্সার। শরীরে একবার ক্যান্সার বাসা বেধে ফেললে তা থেকে পরিত্রাণের উপায় খুবই কম। মুক্ত মূলক  বা ফ্রি রেডিক্যাল দেহের কোষের অস্বাভাবিক ক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে আনারসের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কারণ আমাদের দেশের আনারসে আছে উচ্চমাত্রার ভিটামিন সি ও আন্টি অক্সিডেন্ট।যা কোষের অস্বাভাবিক ক্রিয়া বন্ধ করে এবং দেহকে ফ্রি রেডিকেল বা মুক্ত মূলত থেকে রক্ষা করে। এছাড়াও ত্বকের ক্যান্সার প্রতিরোধে  কাজ করে। এইজন্য প্রতিদিন পরিমিতো আনারস খেলে অন্যান্য জটিল রোগের প্রতিরোধ করা সম্ভব। 

৯. কৃমির সমস্যার সমাধান: কৃমির সমস্যায় ছোট বড় আমরা সবাই ভুক্তভোগী। কৃমির উৎপাত কমাতে নিয়মিত আনারস অথবা আনারসের জুস খান। এছাড়া ক্ষুদ্রান্তের জীবাণু ধ্বংসে আনারস খুবই উপকারী। 

১০.কোষ্ঠকাঠিন্য কমায় এবং মর্নিং সিক্স সেন্স বাড়ায়: কোষ্ঠকাঠিন্যের অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে নিয়মিত আনারস খাওয়া উচিত। এছাড়া আনারস মর্নিং সিক্স সেন্স বা সকালে দুর্বলতা দূর করতে সাহায্য করে। শরীর থাকে সতেজ ও পরিপুষ্ট। 

আনারস খাওয়ার অপকারিতা বা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া 

আনারস খাওয়ার কিছু অপকারিতা আছে সেগুলো জেনে নেয়া যাক –

  • এলার্জি রোগীদের আনারস খাওয়ায় সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। কারণ এলার্জি থাকলে ত্বকে চুলকানি, ফুসকুড়ি ও ত্বক লাল হতে পারে। 
  • ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে আনারস থেকে বিরত থাকুন। আনারসের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে শর্করা থাকে যা ডায়াবেটিসের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। 
  • অতিরিক্ত পরিমাণে আনারস খেলে পেটে অ্যাসিডিটির কারণে ব্যথা হতে পারে। 
  • অতিরিক্ত পরিমাণে আনারস খেলে রক্ত অধিক পরিমাণে তরল হয়ে যাবে। কারণ আনারস রক্ত জমাট বাধার পরিবর্তে রক্ত তরল করে 
  • গর্ভবতীদের জন্য আনারস খাওয়ায় সতর্কতা থাকতে হবে। আনারস খেতে হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে খেতে হবে।
  •  বাতের ব্যাথার রোগীদের জন্য আনারস  না খাওয়া ভালো। 
  • অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে বমি বমি ভাব ও ডায়রিয়া হতে পারে। 
  • পরিমাণের অধিক খেলে অতিরিক্ত এসিড মুখ ও দাঁতের ক্ষতি করতে পারে। 

খালি পেটে আনারস খাওয়ার উপকারিতা 

খালি পেটে আনারস করলে উপকারিতা পাওয়া যায়। প্রতিদিন সকালবেলা খালি পেটে আনারস খাওয়া যেতে পারে। আনারসের মধ্যে উপস্থিত এনজাইম ব্রমেলেইন ও অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ভিটামিন সি রোগ নিরাময়ে সাহায্য করে। এছাড়া ব্রমেলেইন বিষাক্ত পদার্থ শরীর থেকে দূর করে। এছাড়া আনারসের পটাশিয়াম ইলেকট্রোলাইটের  ভারসাম্য রক্ষা করে। 

জ্বরে আনারসের উপকারিতা 

জ্বর ও জন্ডিস রোগীর জন্য আনারস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আনারসে প্রচুর ক্যালরি থাকার কারণে শরীরের শক্তি বৃদ্ধি করে। সর্দি কাশি ও জ্বর জ্বর ভাব রোধ করে। জ্বরের তীব্রতা কমানোর পাশাপাশি দেহের পুষ্টির পরিমাণ ঠিক রাখে। তাই জ্বর হলে আনারস খান। ভালো উপকার পাওয়া যায়। 

দুধ ও আনারস একসাথে খেলে কি হয়? 

প্রচলিত একটা কুসংস্কার হচ্ছে আনারস ও দুধ একসাথে খেলে বিষ হয়ে যায়। এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন একটা কথা। দুধ হল একটি আদর্শ খাবার। দুধের মধ্যে প্রায় সকল ধরনের উপাদান বিদ্যমান থাকে। এছাড়া দুধ হল ক্ষারধর্মী। অন্যদিকে আনারস এসিড জাতীয়  বা টক জাতীয় খাবার। দুধের মধ্যে যখন টক জাতীয় কোন কিছু দেওয়া হয় তখন দুধ ফেটে যায়। ঠিক তেমনি দুধ ও আনারস একসঙ্গে খেলে বদ হজম, পেট ফাপা হতে পারে। কিন্তু বিষক্রিয়ার সম্ভাবনা একেবারে নেই। 

আনারস চাষের উপযুক্ত সময় কখন? 

আনারস চাষের জন্য উপযুক্ত মৌসুম হলো- জুন থেকে আগস্ট মাস আনারস চাষের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। যদি পানির ব্যবস্থা বা সেচের ব্যবস্থা থাকে তাহলে মাঘ মাস থেকে মধ্য ফাল্গুন মাসেও আনারস চাষ করা যায়। 

মন্তব্য

আমরা এতোক্ষন আলোচনা করলাম আনারস খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা নিয়ে। এছাড়া বিভিন্ন প্রশ্ন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আশা করি আপনারা সবাই ভালোভাবে বুঝতে পেরেছেন। যদি কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে আমাদের অবশ্যই জানাবেন। ধন্যবাদ। 

খাদ্য ও পুষ্টি নিয়ে আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *