লটকন এমন একটা ফল যা স্বাদে টক ও মিষ্টি। লটকনের বৈজ্ঞানিক নাম “Baccaurea Motleyana” লটকন সম্পর্কে আমরা কমবেশি সবাই জানি। বাড়ির আনাচে কানাচে, বাগানে, জঙ্গলে লটকন গাছ দেখা যায়। লটকন ফল দেখতে সুন্দর গোলাকার এবং পাকলে হলুদ বর্ণ ধারণ করে। আমরা তো সবাই লটকন খাই। কিন্তু আমি অনেকেই জানিনা লটকন খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা গুলো কি কি? আজকে আমরা আলোচনা করব লটকন খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা নিয়ে। এছাড়া আপনাদের বোঝার  সুবিধার্থে লটকনের বিভিন্ন পুষ্টিগুণ এবং লটকন সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করব। আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন –

লাটকনের পুষ্টিগুণ 

লটকন টক মিষ্টি যুক্ত সুস্বাদু একটি ফল। দেখতে যেরকম সুন্দর তেমনি লটকনের ভিতর আছে নানা রকম পুষ্টিগুণ। কিন্তু আমরা অনেকেই লটকনের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে অজানা। সুস্বাদু এই ফলটির পুষ্টিগুণ সম্পর্কে আমাদের সকলেরই জানা উচিত –

একটি পরিপক্ক লটকনের ১০০ গ্রাম শাঁসে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদান–

  • ভিটামিন বি ২ –০.১৯ মিলিগ্রাম 
  • ভিটামিন বি ১– ১০.৪ মিলিগ্রাম 
  • আমিষ– ১.৪২ গ্রাম 
  • চর্বি – ০.৪৫ গ্রাম 
  • খনিজ – ০.৯ গ্রাম 
  • লৌহ – ০.৩ গ্রাম 
  • খাদ্য শক্তি – ৯১ কিলো ক্যালরি। 
  • ক্যালসিয়াম – ৯ গ্রাম
  • আয়রন – ৫.৩৪ মিলিগ্রাম। 

এছাড়া পাওয়া যায় ভিটামিন সি। সাধারণত বইয়ের ভাষায় লটকন কে ভিটামিন বি এবং বি ২ সমৃদ্ধ ফল বলা হয়। এই ভিটামিন বি ২ আমাদের শরীরের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। নিয়মিত আমাদের লটকন খাওয়ার অভ্যাস করা উচিত 

লটকন ফলের উপকারিতা

লটকন ফলের নানান উপকারিতা। পুষ্টিতে ভুরপুর লটকন ফলে কোনো ক্ষতিকর উপাদান না থাকায় সব বয়সের মানুষ লটকন ফল খেতে পারে। লটকন ফলের উপকারিতা সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি না। আমরা এখন এ-ই বিষয়ে বিস্তারিত জানবো –

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে 

শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য লটকন খাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। গবেষকদের মতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান উপাদান হলো ভিটামিন সি। ভিটামিন সি যেমন শরীরকে বিভিন্ন রোগের হাত থেকে রক্ষা করে তেমনি দেহের ভিটামিন সি এর চাহিদা পূরণ করে ইমিউনিটি সিস্টেম বৃদ্ধি করে। আর এই ভিটামিন সি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় লটকনে।

পুষ্টিবিদ দের  মতে নিজেকে স্বাভাবিক সুস্থ সবল রাখার জন্য প্রতিদিন দুই থেকে তিনটি করে লটকন খাওয়া উচিত। এতে করে শরীরে ভিটামিন সি এর ঘাটতি থাকলে তা পূরণ হবে। এছাড়া রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো প্রোটিন। ১০০ গ্রাম সমপরিমাণ লটকনে ১.৪২ গ্রাম আমিষ পাওয়া যায়। যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক হিসেবে  কাজ করে। 

কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধ করে 

মারাত্মক কোলন ক্যান্সার থেকে মুক্ত করতে পারে লটকন। লটকনে প্রচুর পরিমাণে আছে ভিটামিন বি, সি, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম। চিকিৎসার মতে এসব পুষ্টি উপাদান দেহের কালন ক্যান্সার প্রতিরোধ করে এবং কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। এছাড়া লটকনের অন্যান্য উপাদান ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে। 

রুচি বৃদ্ধি করে 

খাবারের অরুচি আমাদের প্রায় প্রত্যেকে রই নিত্যদিনের সমস্যা। ছোট বড় সবাই সাধারণত এই সমস্যায় ভুগে থাকে। এই সমস্যার সমাধান হতে পারে লটকন খাওয়ার মাধ্যমে। রুচি বাড়ানোর জন্য লটকন খুব ভালো কাজ করে।লটকনে আসে ভিটামিন সি  যা রুচি  বাড়াতে সাহায্য করে।

অনেক সময় দেখা যায় প্রসবকালীন সময়ের পরে গর্ভবতী মায়ের খাওয়ার রুচি কমে যায়। অথবা গর্ভাবস্থায় খাবারে অরুচি চলে আসে। তো এই সময় লটকন খেলে আস্তে আস্তে মুখের রুচি ফিরে আসে। লটকন এমনিতেও খাওয়া যায় আবার আচার তৈরি করে দীর্ঘদিন খাওয়া যায়। নিয়মিত খেলে দেহে ভিটামিন সি সহ অন্যান্য পুষ্টির চাহিদা পূরণ হয়। খাবারে অরুচি কমে যায় এবং রুচি বৃদ্ধি পায়। 

ডায়রিয়া দূর করে 

লটকন ফল যেমন পুষ্টিতে ভরপুর তেমনি  লটকনের পাতার উপকারী গুণ আছে। পেটের পীড়া বা ডায়রিয়া প্রতিকারে লটকনের পাতা ভালো ফলাফল দেয়। ডায়রিয়া হলে লটকনের পাতা গুড়ো করে হালকা চিনি মিশিয়ে খেয়ে নিলে ডায়রিয়া ভালো হয়ে যায়। এছাড়া লটকন গাছের মূল থেতলিয়ে   রস করে খেলে পেটের পীড়া ভালো হয়ে যায়। বিশেষ করে গ্রামে মায়েরা এই বুদ্ধিটা ভাল জানে। ডায়রিয়া হলেই এই টোটকা বুদ্ধিটা কাজে লাগাও। 

অ্যানিমিয়া রোগ থেকে রক্ষা করে 

অ্যানিমিয়া হলো রক্তের রোগ। দেহে রক্ত শূন্যতার অভাব দেখা দিলে এই রোগ হয়। নিয়মিত লটকন খাওয়ার অভ্যাস এই রোগ থেকে মুক্তি দিতে পারে। অ্যানিমিয়া হলে দেহে লোহিত রক্ত কণিকার সংখ্যা বা হিমোগ্লোবিনের সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় কমে যায়।

ফলে রক্তে অক্সিজেনের প্রবাহ কমে যায় এবং দেহে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয় । দেহে আয়রনের ঘাটতি হলে সাধারণত এই সমস্যাগুলো দেখা দেয়। লটকনে থাকে প্রচুর পরিমাণে আয়রন। নিয়মিত লটকন খেলে আয়রনের ঘাটতি পূরণ হবে। ফলে অ্যানিমিয়া রোগ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যাবে। তাই নিয়মিত লটকন খাওয়ার চেষ্টা করুন তাহলে অ্যানিমিয়া থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন। 

ত্বক ভালো রাখে 

ত্বকের সুস্থতায় লটকনের উপকারিতা অনেক। ত্বকের সুস্থতার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান হলে ভিটামিন সি। আর এ-ই ভিটামিন সি প্রচুর পরিমাণে লটকনে পাওয়া যায়। ভিটামিন সি এর অভাবে ত্বকের নানা ধরনের অসুখ দেখা দেয়। এলার্জি, ফুসকুড়ি ওঠা, ব্রণ, ইত্যাদি নানান  ধরনের চর্ম রোগের দেখা যায়। লটকনে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও বিভিন্ন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান থাকার কারণে ত্বকের  এই সমস্যাগুলো দূর করে এবং ত্বক রাখে উজ্জ্বল ও মলিন। 

হাড় গঠনে সাহায্য করে 

হাড় গঠনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে ক্যালসিয়াম। আর এই ক্যালসিয়াম প্রচুর পরিমাণে লটকনে পাওয়া যায়। ১০০ গ্রাম সমপরিমাণ লটকনে ৯ গ্রাম ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়। লটকনে বিদ্যমান এই ক্যালসিয়াম দেহের হার গঠনে বড় ভূমিকা পালন করে।

শিশুদের ক্ষেত্রে হারের গঠন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয়। সঠিকভাবে হাড়ের গঠন না হলে, হাড় শক্তিশালী না হলে শরীর স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে বাধাগ্রস্ত হবে এবং বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হবে। এছাড়া এছাড়া লটকনে বিদ্যমান প্রোটিন দেহের স্বাভাবিক গঠনে সহায়তা করে। 

ক্যালরির চাহিদা পূরণ করে 

১০০ গ্রাম পরিমাণ একটি লটকনে ৯১ কিলো ক্যালরি খাদ্য শক্তি থাকে। যা দেহের ক্যালরির চাহিদা অনেকটা পূরণ করে। একজন মানুষের দৈনিক প্রচুর পরিমাণে ক্যালরির প্রয়োজন হয়। আর সেই ক্যালোরি গুলো আমরা পেয়ে থাকি বিভিন্ন খাদ্য থেকে। তো এক্ষেত্রে লটকন ক্যালরির চাহিদা কিছুটা হলেও পূরণ করতে পারে। 

একটি কাঁঠালে যে পরিমাণ ক্যালরি পাওয়া যায়, তার দ্বিগুন কেনরে পাওয়া যায় একটি ১০০ গ্রাম সমপরিমাণ লটকনে। তাহলে বুঝতেই পারছেন কেন লটকন খাওয়ার প্রয়োজন। এছাড়া লটকন আরো বিভিন্ন ধরনের রোগ থেকে আমাদেরকে বাঁচায়। যেমন লটকনের মধ্যে আছে ভিটামিন বি১, যা বেরিবেরি নামক রোগ থেকে আমাদের রক্ষা করে। ভিটামিন বি১ বা থায়ামিনের অভাবেই মূলত বেরিবেরি রোগ হয়। 

গর্ভাবস্থায় লটকন খাওয়ার উপকারিতা 

দেহে আয়রনের অভাব পূরণের জন্য গর্ভবতী মহিলাদের লটকন খাওয়া দরকার। কারণ গর্ভবতীদের দেহে আয়রনের অভাব হলে অনাগত বাচ্চার ওজন কমে যাওয়ার ভয় থাকে এবং প্রসবকালীন সময়ে রক্তস্বল্পতা সমস্যা হতে পারে। এইজন্য গর্ভবতী মহিলার প্রতিদিন ২৭ মিলিগ্রাম আয়রন প্রয়োজন। ভ্রুনের ত্বক ও হাড়ের গঠনেও আয়রন ও ক্যালসিয়াম প্রয়োজন। আর এই প্রয়োজনীয় উপাদান গুলো লটকনে পাওয়া যায়। 

গর্ভাবস্থায় লটকন খাওয়া যাবে কিনা? 

উত্তর হলো “হ্যাঁ”। গর্ভাবস্থায় পরিমান মতো লটকন খাওয়া যাবে। কারণ লটকন প্রসব কালীন জটিলতা, রক্তস্বল্পতা থেকে রক্ষা করে। ভ্রনের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। 

লটকনের বিচি খেলে কি হয়? 

লটকনের বিচি খেলে উপকারিতা পাওয়া যায়। লটকনের বীজ সাধারণত প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে গনোরিয়া রোগের জন্য। তাই লটকনের বিচি খাওয়া যায়। 

লটকন ফলের ইংরেজি নাম কি? 

Burmese Grape”    –  – লটকন ফল এর ইংরেজি নাম। Baccaurea Motleyana – লটকন ফলের বৈজ্ঞানিক নাম। 

লটকন ফল কি ভিটামিন? 

লটকন ফলকে বলা হয় ভিটামিন বি১ ও বি২ সমৃদ্ধ ফল। ভিটামিন বি ১ এবং বি২ ছাড়াও লটকনে আরো আছে, ক্যালসিয়াম, আয়রন, লৌহ, খাদ্য শক্তি, আমিষ, খনিজ ইত্যাদি। 

লটকন খেলে কি ওজন বাড়ে? 

উত্তর হলো “না ” লটকন খেলে ওজন বাড়ে না। লটকন খেলে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে। লটকনের জলীয় অংশ রক্তশূন্যতা কমানোর পাশাপাশি ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে। এবং থায়ামিন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের কারণে মুখে ঘা হয় না। তাই লটকন খেলে ওজন বাড়ে না। 

খাদ্য ও পুষ্টি নিয়ে আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *