গ্রাম থেকে শহরে দেশের সব জায়গায় মশার উপদ্রব দিন দিন বেড়েই চলেছে।মশা মারতে কামান লাগবে এরকম একটা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে।মশার যন্ত্রণায় আমরা কমবেশি সবাই অতিষ্ঠ সেটা আমাদের কামড় দেওয়ার পরে বুঝা যায়।সেজন্য আমাদের একটা প্রতিকার প্রয়োজন কিন্তু কোন কোনভাবেই এই মশা থেকে নিস্তার পাচ্ছি না আমরা।মশার উপদ্রব কমানোর জন্য মশার কয়েল তৈরির ব্যবস্থা নিতে পারি। যার ফলে  আশেপাশের মানুষ থেকে শুরু করে গ্রাম থেকে গ্রাম অঞ্চলে সবার কাছে স্বস্তির একটা ব্যাপার হবে। বাংলাদেশের শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ মানুষ মশার কয়েল ব্যবহার করে থাকে। তাই সঠিক প্রচার-প্রচারণা করলে আমরা এই ব্যবসা থেকে অবশ্যই লাভবান হতে পারব। 

মশার উপদ্রব বেশি হওয়াতে মশার কয়েলের চাহিদা প্রচুর। যদি আপনার ব্যবসা করার পর্যাপ্ত সামর্থ্য ও ধৈর্য থাকে তাহলে এই ব্যবসা আপনার জন্য। কারণ পর্যাপ্ত মূলধন না থাকলে এই ব্যবসায় নামা উচিত নয়। তাই এ ব্যবসা কিভাবে করতে পারব এবং কি কি ব্যবস্থা লাগবে সবকিছু আমাদের জানতে ও বুঝতে হবে হবে 

প্রয়োজনীয়তাঃ

এই ব্যবসায় নামার জন্য আপনাকে প্রথমে প্রয়োজনীয় ধাপগুলো পূরণ করতে হবে৷ আপনাকে অবশ্যই জানতে হবে কিভাবে মশার কয়েল তৈরি করা হয়, কি কি মেশিন লাগবে, কোন কাচামাল দিয়ে তৈরি করতে হয়, কোথায় বিক্রি করলে লাভ করতে পারবেন,কিভাবে খরচ কমাতে পারবেন। সব কিছু নিয়েই পরিকল্পনা করে রাখতে হবে।সব সময় চাইবেন যেন সততার সাথে ব্যবসা করা যায়।অসৎভাবে ব্যবসা করে কখনোই লাভবান হতে পারবেন না, কারণ ব্যবসা একদিনের জন্য না। সৎ ভাবে ব্যবসা করলে দীর্ঘদিন ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারবেন, সবার সাথে সম্পর্ক ভালো থাকবে এবং মালামাল বিক্রি হবে বেশি। সবদিক বিবেচনা করে ব্যবসা করতে হবে যাতে করে সবার কাছে আপনার মালামালের চাহিদা বেশি থাকে। 

কিভাবে মশার কয়েলের ব্যবসা শুরু করবেন? 

মন চাইলো আর আপনি ব্যবসা শুরু করলেন এমন তো আর হতে পারে না। আপনাকে যে আমার কথা শুনেই ব্যবসা করতে হবে এমন নয়। ব্যবসা করার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া আপনার জানতে এবং বুঝতে হবে। এজন্য আপনাকে যেতে হবে যারা মশার কয়েলের ব্যবসা করে তাদের সাথে কথা বলতে হবে। ফ্যাক্টরি পরিদর্শন করবেন,কি কি লাগে, কোথা থেকে মেশিন আনা হয়, কিভাবে কাজ করে,মেশিনের কত টাকা দাম, সবকিছু আপনার জেনে নিতে হবে। তারপর আপনি ভাববেন আপনার ব্যবসা করা উচিত? কি উচিত নয়।কারণ এই ব্যবসা কম টাকার ব্যবসা নয়, লক্ষ লক্ষ টাকার ব্যবসা। পর্যাপ্ত মূলধন না থাকলে এ ব্যবসায় আসা উচিত নয়। এখন আসি এ ব্যবসা করতে গেলে কত টাকা লাগতে পারে। 

মূলধন

যেহেতু আপনি একটু বড় ব্যবসা খুলতে চাচ্ছেন সে ক্ষেত্রে আপনার অবশ্যই বিপুল পরিমাণ মূলধন প্রয়োজন হবে।তাই আপনার অবশ্যই উচিত মূলধন সংগ্রহ করা। যদি পর্যাপ্ত মূলধন না থাকে তাহলে আপনি কোন ব্যাংক থেকে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে লোন নিতে পারেন। ব্যবসায়ের  ক্ষেত্রে আপনি কর্মসংস্থান ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে নিতে পারবেন।যদি পর্যাপ্ত মূলধন থাকেও তারপরও আপনার ৫০থেকে ৮০ লাখ টাকা পর্যন্ত মূলধন লাগতে পারে এছাড়াও ব্যবসা চালু করার পর আনুষঙ্গিক কিছু কাজ বাকি থাকেই।এখন আসি আপনার মেশিনের মালামাল বাবদ কি কি লাগবে 

প্রয়োজনীয় মেশিন 

যেহেতু এই মেশিনগুলা আমাদের দেশে তৈরি হয় না সরাসরি চায়না থেকে মেশিনগুলো নিয়ে আসতে হয় তাই এর দাম একটু বেশিই হবে। চায়না থেকে মালামাল আনতে গেলে বাংলাদেশ সরকারকে ভ্যাট ট্যাক্স দিতে হবে এবং পরিবহন খরচ থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক আরও খরচ বৃদ্ধি পাবে। 

মশার কয়েল তৈরির জন্য সাধারণত যে মেশিন গুলো লাগে তার দামের লিস্ট সহ দেওয়া হল :

  • ৪ পাঞ্চ মেশিন 
  • ৭ পাঞ্চ মেশিন 
  • ১২ পাঞ্চ মেশিন 
  • ২১ পাঞ্চ মেশিন 

যেহেতু আমাদের চায়না  থেকে কিনতে হবে তাই ডলার এর দাম কম বেশি হওয়ার কারণে মেশিন গুলোর দাম কম বেশি হতে পারে। 

  • ৪ পাঞ্চ মেশিন ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকার মধ্যে পাবেন।
  • ৭ পাঞ্চ মেশিন ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকার মধ্যে পাবেন। 
  • ১২ পাঞ্চ মেশিন ৩২ থেকে ৩৫ লাখ টাকার মধ্যে পাবেন। 
  • ২১ পাঞ্চ মেশিন ৬৫ থেকে ৭০ লাখ টাকার মধ্যে পাবেন।

এছাড়াও এই মেশিন গুলোর সাথে আরো কিছু পার্টস রয়েছে যেগুলো ছাড়া এই মেশিন কাজ করবে না। তাই আলাদাভাবে এই মেশিন এর পার্টস গুলো কিনতে হবে। 

  • ৬০ কেজি মিক্সার মেশিন 
  • দুই মডেলের দুইসেট  কয়েল ডাইস 
  • একটি পাঞ্চ কাটিং মেশিন যার ক্ষমতা ঘন্টায় ২০০০ হতে হবে
  • কনভেয়ারসহ হাইপ্রেসার কুণ্ডলী লেয়ার তৈরীর মেশিন
  •  তিন সেট কয়েল কাটিং পাঞ্চ মেশিন 

উপরের মেশিন এবং পার্টস গুলো কয়েল তৈরি জন্য অবশ্যই লাগবে এবং এই মেশিনগুলো সরাসরি কারখানায় প্রতিস্থাপন করতে হবে । তা না হলে কয়েলের উৎপাদন এবং বাজারজাতকরন করা যাবে না। সরাসরি চায়না থেকে মেশিন কেনার লিংক মেশিন কেনা হয়ে গেলে আপনার কারখানায় তখন ইঞ্জিনিয়ার এবং দক্ষ কর্মী লাগবে যারা কয়েল তৈরিতে শ্রম দিবে। এরপর আপনার কারখানা তৈরির কাগজপত্র ঠিক করতে হবে। নিচে কাগজপত্রের নাম সহ দেওয়া হলঃ

  • ট্রেড লাইসেন্স 
  • ভ্যাট ও টিন সার্টিফিকেট 
  • বিএসটিআই অনুমোদন 
  • ট্রেডমার্ক 
  • পিএসপি লাইসেন্স 
  • ফায়ার লাইসেন্স  
  • পরিবেশের ছাড়পত্র 
  • আয়কর প্রত্যয়ন পত্র 
  • কারখানার লেআউট
  • প্রসেস ফ্লোচার্ট 
  • পরিবেশগত সনদপত্র 
  • কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক সনদপত্র 

ট্রেড লাইসেন্সঃ আপনাদের জেলা শহরের পৌরসভা/সিটি কর্পোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হবে। আর গ্রামাঞ্চলে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সংগ্রহ করতে হবে। 

ভ্যাট ও টিন সার্টিফিকেটঃ  ভ্যাট ও টিন সার্টিফিকেট  কাগজপত্রের জন্য অনলাইনে টিন সার্টিফিকেট পাওয়া যাবে তবে একক মালিকানা হলে নিজের নামে করতে হবে আর তা নাহলে ব্যবসায়ের নামে করতে হবে। ভ্যাটের জন্য আপনার ব্যবসায়ীক কাগজ নিয়ে ভ্যাট অফিসে যেতে হবে সেখান থেকে ভ্যাট এর সব কাজ শেষ করতে হবে।

ট্রেডমার্কঃ ট্রেড মার্ক  শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয়। যেহেতু আপনি ব্যবসাটি আপনার নিজস্ব লোগোতে করবেন তাই আপনার নিজস্ব ট্রেড মার্ক প্রয়োজন হবে।

পিএসপি লাইসেন্সঃ ঢাকার খামারবাড়ি থেকে পিএসপি লাইসেন্স করতে হবে। উপরের সবগুলা লাইসেন্স এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ লাইসেন্স। সবগুলা লাইসেন্স আপনার অনুমোদন অবশ্যই লাগবে। 

সবশেষে বিএসটিআই অনুমোদন লাগবে। বিএসটিআই থেকে অনুমোদন না দিলে আপনি ব্যবসা করতে পারবেন না। তাই উপরের সবগুলো কাগজপত্র ঠিকঠাক করে রাখতে হবে তারপর বিএসটিআই অফিসের কর্মকর্তাগন আপনার কারখানাতে পরিদর্শন করে আপনাকে বি এস টি আই এর অনুমোদন দেওয়া হবে।এছাড়া অন্যান্য কাগজপত্র সরকার চাইলে যেকোনো সময় নিতে পারে। আপনাকে মোটামুটি সবগুলো কাগজপত্র ঠিক রেখে তারপরে ব্যবসা করার চিন্তাভাবনা করতে হবে। 

মশার কয়েল তৈরির কাঁচামাল সংগ্রহ 

জন্য  জন্য কয়েলের জন্য আপনাদের কিছু কাঁচামাল প্রয়োজন পড়বে  সেগুলো হলঃ

  • পাইরেথ্রাম
  • এমজিকে এন
  • বাটলেটেড হাইড্রোক্সিটোলিউইন 
  • ডাইমফ্লথ্রিম
  • এমবিথোথ্রিন
  • পাইথ্রেয়েড
  • ম্যাফ্লুথ্রিন
  • পাইপারনিল বাটক্রাইড
  • এমজিকে ২৬৪ এন
  • অ্যালেথ্রিন

পাইরেথ্রাম এটি কসিনিয়াম নামের গাছের একধরনের গুড়া। তবে গুড়াটি পাইরেথ্রাম গাছটির ফুল থেকে তৈরি হয়।এমজিকে এন এই উপাদানটি পাইথ্রেয়েডকে আরও উন্নত ও কড়া করতে ব্যবহার করা হয়।ডাইমফ্লথ্রিম এটি এক ধরনের কীটনাশক। যা মশার কয়েল তৈরির খুবই প্রয়োজনীয় উপাদান। এটি ছাড়া মশার কয়েল বানানো অসম্ভব।

কাঁচামাল সংগ্রহ হয়ে গেলে এরপর প্রয়োজন পড়বে তা বাজারজাতকরন।কারণ পণ্য করে ভুল তৈরি করে তা বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে আর তা না করতে পারলে পণ্য নষ্ট হওয়ার  সম্ভাবনা বেশি। যেহেতু আপনি একটা ফ্যাক্টরি খুলতেছেন তাই যারা কয়েলের মার্কেটে ব্যবসা করতেছে তাদের চেয়ে কম দামে  এবং ভালো কমিশনে পণ দিতে হবে। না হলে নতুন কোম্পানি প্রচার হতে সময় লাগবে।প্রচার প্রচারণা বাড়ানোর জন্য প্রচুর মার্কেটিং করে  লিফলেট এবং দোকানের সামনে স্টিকার লাগিয়ে রাখতে হবে।

যেহেতু শহরের দিকে বড় বড় কোম্পানি মার্কেট নিয়ে নিয়েছে সেহেতু আপনার চাহিদা থাকবে গ্রামের বাজারের দিকে। দোকানদারদের  ভালো কমিশনে কয়েল দিতে পারলে তারা পণ্য তাড়াতাড়ি বিক্রি  করে দিবে। পরে আপনার যত সাপ্লাই বাড়াবেন তত চাহিদা থাকবে। 

পরিশেষে একটা কথা বলতে চাই, পরিশ্রম সাফল্যের চাবিকাঠি। পরিশ্রম ও মেধা খাটিয়ে ব্যবসা করতে হবে।অসৎ উপায়ে  ব্যবসা করে লাভ হবে না। মশার কয়েল বিক্রির জন্য আপনাকে অবশ্যই সময় দিতে হবে। আপনার সময় ও মার্কেটিং পলিসি আপনার ব্যবসাকে আরো উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাবে।যদিও অনেক ব্যবসায়ই লাভ লস থাকবেই তবুও সৎ ভাবে কাজ করে গেলে সফলতার মুখ অবশ্যই দেখা যাবে। তাই লাভ লসের ঝুঁকি নিয়েই আপনাকে ব্যবসায় নামতে হবে। ধন্যবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *