মানব শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা ঠিক রাখতে হলে নিয়মিত ঘুমানোর সঠিক অভ্যাস প্রয়োজন। মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততার মাঝে শরীরকে বিশ্রাম দেওয়ার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হচ্ছে “ঘুম বা নিদ্রা” সুস্থ থাকার জন্য ঘুমের কোন বিকল্প নেই। একজন মানুষের সারাদিনের পরিশ্রম, স্ট্রেস ও ক্লান্তি  দূর করে পর্যাপ্ত ঘুম। একজন মানুষের যদি পর্যাপ্ত ঘুম না হয় বা অনিয়মিত হয় তাহলে সেই ব্যক্তি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার মত কঠিন পরিস্থিতি মুখোমুখি হতে পারে। 

রাত জাগার অভ্যাস আমাদের প্রায় সকলেরই আছে। কেউ রাত জাগে নিত্য প্রয়োজনীয় কাজের উদ্দেশ্যে, আবার কেউ পড়ালেখার উদ্দেশ্যে, কেউ বা সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় কাটায়, আবার কেউ এমনি এমনি রাত জাগে। কিন্তু আমরা অনেকেই জানিনা রাতে দেরিতে ঘুমালে বা রাত জাগলে আমাদের শরীরে কি প্রভাব পড়ে? আমাদের শরীর কি বিপদের সম্মুখীন হয়? তো আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় রাতে দেরিতে ঘুমানোর বিভিন্ন ক্ষতিকর দিক নিয়ে। দেরি না করে চলুন তাহলে শুরু করা যাক –

১.মানসিক সমস্যা 

রাতে দেরিতে ঘুমানো মানসিক ভারসাম্যতে অনেক বেশি প্রভাব ফেলে। সারাদিন আমাদের বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। সারাদিনের এই ব্যস্ততার পর রাতে দরকার বিশ্রাম। রাতে আমাদের মস্তিষ্কের বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন।

যদি এই সময় আমরা বিশ্রাম না নিয়ে কাজে ব্যস্ত থাকি এবং অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকি তাহলে ব্রেইনের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হ্রাস পাবে। এর ফলশ্রুতিতে স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া, মানসিক চাপ, হাইপোলার ডিজঅর্ডার ও স্লো কগনিভিটির মতো জটিল সমস্যার শুরু হয়ে যাবে। এইজন্য রাতে দেরিতে ঘুমানো উচিত নয়। 

২। চোখের সমস্যা 

মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ একটা অঙ্গ হচ্ছে চোখ। চোখ ছাড়া এই বিশ্বজগত অন্ধকার। একটানা রাতে দেরি করে ঘুমালে চোখের উপর তা বিরুপ প্রভাব  ফেলে। চোখের নিচে কালো দাগ পরে এবং চোখ জ্বালাপোড়া করে। 

ধারাবাহিকভাবে দেরিতে ঘুমানোর অভ্যাস চলতে থাকলে একসময় চোখে ঝাপসা দেখা যাবে। চোখ দিয়ে পানি পরা এবং চোখের ব্যথা হওয়া। কেউ যদি মোবাইল, কম্পিউটার বা ল্যাপটপের সামনে বসে রাত জাগে তাহলে তাদের জন্য আরও বেশি সমস্যার উৎপত্তি হতে পারে। কারণ মোবাইল কম্পিউটারে ল্যাপটপের আলো সরাসরি চোখে লাগার কারণে চোখ সেই আলো শোষণ করে, চোখ ব্যথার সাথে মাথা ব্যথা হতে পারে।  তো দেরিতে ঘুমানোর অভ্যাস আজকেই  আমাদের পরিহার করতে হবে। 

৩। হার্টের সমস্যা

হার্ট কে সুস্থ রাখতে ও হার্টের সঠিক কার্যক্ষমতা ধরে রাখার জন্য প্রতিরাতে আমাদের সবাইকে ৭ থেকে ৮ ঘন্টা ঘুমানোর প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। অন্যথায় হার্ট ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে হার্ট অ্যাটাকের মত জটিল রোগের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করবে।উদাহরণ স্বরূপ বলতে গেলে “একটা কম্পিউটারের মাদারবোর্ড যখন দুর্বল হয়ে যায় তখন সাথে সাথে কম্পিউটারে পারিপার্শ্বিক আরো বিভিন্ন জিনিসের সমস্যা দেখা দেয় “ঠিক তেমনি যখন দেহের প্রধান অংশ হার্ট দুর্বল হয়ে যায় তখন দেহে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়। তাই হার্টের সুস্থতার জন্য রাত জাগার অভ্যাস বাদ দিতে হবে। নিয়মিত ঘুমানোর অভ্যাস করতে হবে। 

৪। ত্বকের সমস্যা 

রাত জেগে থাকলে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ত্বকের  বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। দেরিতে ঘুমানোর ফলে কার্টিজল স্ট্রেস হরমোনের ক্ষরণের মাত্রা বেড়ে যায় এবং এর ফলে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। ত্বকের উজ্জ্বলতা কমে ত্বক মলিন হয়ে যায়। এছাড়া মুখে বিভিন্ন ধরনের ব্রণ, কালো দাগ দেখা দেয়। এজন্য উচিত রাতে খুব দ্রুত ঘুমিয়ে যাওয়া এবং সকালে খুব দ্রুত ঘুম থেকে ওঠা। 

৫। রক্তচাপ বেড়ে যায় 

রাতে দেরিতে ঘুমানোর ফলে রক্তচাপের মাত্রা অনিয়ন্ত্রিত ভাবে বেড়ে যায়। এর ফলে দেহে  বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়। রক্ত চাপের  মাত্রা বেড়ে গেলে হার্ট অ্যাটাক ব্রেন স্ট্রোকের মতো কঠিন রোগের সৃষ্টি হয়। এছাড়া কিডনির উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে অনেক দেরিতে ঘুমানোর বদ অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে।

৬। ওজন বেড়ে যাওয়া 

দীর্ঘদিন রাত জাগলে একসময় সেটা অভ্যাসে পরিণত হয়। আর রাতে দেরিতে ঘুমানোর অভ্যাস যদি অনেকদিন যাবত থাকে তাহলে শরীরের হজম শক্তি কমে যায়, বদহজম হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় পাকস্থলীতে গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং সেই সাথে দেহের ওজন ও বেড়ে যায়। যখন ওজন বেড়ে যায় তখন আবার শরীরে বাসা বাধে বিভিন্ন রোগ যেমন প্রেসার, সুগার, কোলেস্টেরল। 

৭। দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা 

দীর্ঘদিন যাবত রাত জাগলে বা  দেরিতে ঘুমানোর ফলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা অনেকাংশে হ্রাস পেয়ে যায়। পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ার কারণে মস্তিষ্কের বিশ্রামের পরিমাণ কমে যায়। এর ফলে মস্তিষ্ক দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এছাড়া দেরিতে ঘুমানোর অভ্যাস শিশুদের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। কারণ শিশুরা বড়দের কাছ থেকেই তো শেখে। বড়রা যখন দেরিতে  ঘুমায় তখন শিশুদের আস্তে আস্তে এই অভ্যাস হয়ে যায়। এর ফলে শিশুরা দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধিতে বাধা প্রাপ্ত হয়। 

ঘুম না আসার কারণ ও সমাধান 

ঘুম না আসা এই সমস্যাটি যে কত কষ্টের শুধুমাত্র তারাই বুঝে যাদের ঘুমের সমস্যা আছে। অনেকেই আছেন শুয়ে পড়ার  কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েন। আবার অনেকে আছেন দীর্ঘক্ষণ শুয়ে থেকে ঘুমের চেষ্টা করলেও ঘুম আসে না। ঘুম না আসার প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয় টেনশন। দ্বিতীয়ত কারণ দীর্ঘদিন দেরিতে ঘুমানোর ফলে তা অভ্যাসে পরিণত হওয়া। 

ঘুম না আসার সমস্যার সমাধান হল, টেনশন করা যাবেনা, ঘুমানোর আগে সমস্ত ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি দূরে সরিয়ে রাখতে হবে, ঘুমানোর আগে হালকা ব্যায়াম করা যেতে পারে, ঘুমানোর আগে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হতে হবে, ঘুমানোর আগে নিজ ধর্মীয় দোয়া-দরুদ পড়া। তারপরও যদি ঘুম না আসে তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। 

লেখকের কথা 

এতক্ষণ আলোচনা করা হলো রাতে দেরিতে ঘুমানোর বিভিন্ন ক্ষতিকর বিষয় নিয়ে। আশা করি আপনারা আমাদের আর্টিকেলের মাধ্যমে বুঝতে পেরেছেন রাতে দেরিতে ঘুমানোর জন্য কি কি জটিল সমস্যা হতে পারে। আরো কোন প্রশ্ন থাকলে আমাদেরকে কমেন্টে জানিয়ে দিবেন। আমরা গুরুত্ব সহকারে আপনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ। 

স্বাস্থ্য টিপস নিয়ে আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *